ইস্, সে কী বীভৎস দৃশ্য! আজো মনে করলে জরিনার হাড় বরফ হয়ে আসে। কয়েক মুহূর্ত কী করে কেটেছে কিছু মনে নেই তার।
পরের ছবিটা যা মনে পড়ে তা হচ্ছে জরিনা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। আর বউটা দুহাতে দুচোখ ধরে কাটা মুরগির মতো দাপাচ্ছে মেঝেয়। তার চিৎকারে বধির হয়ে আসছে কান। সেই বুড়িটা ছুটে এসেছে। কাঁদতে কাঁদতে জেগে উঠেছে কোলের বাচ্চারা। বড়রা বিস্ফারিত চোখে বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছে। নূরুন্নাহার উঠে দাঁড়িয়েছে।
চুনের গরম পানি ছুঁড়ে মেরেছিল ওরা। এক পলক দেখেছিল জরিনা তিন চারটে নারকী মূর্তি প্লাটফরমে দাঁড়ানো।
বউটা তার ডাগর দুচোখে কোনদিন আর কিছু দেখতে পাবে না। তার স্বামী এসে দেখবে, তার বউ অন্ধ হয়ে গেছে।
চেন টানো, গাড়ি থামাও। সবাই বলেছিল।
পুলিশ ডাকো। আরেকজন বলেছিল।
আর বউটা তখনো চিৎকার করছে।
জরিনা বলেছিল, না, গাড়ি থামবে না। তারপর বউটাকে দুহাতে সোজা করে বসিয়ে বলেছে, আপনারা কেউ পানি আনুন।
পানি এলে পরে ধীরে ধীরে তার মুখ চোখ ধুইয়ে দিয়েছে। এতক্ষণ শান্ত ছিল কী করে সে? কোথা থেকে সে পেয়েছিল এই শক্তি? নূরুন্নাহার, তার মায়ের পেটের বোন, সে পর্যন্ত বিহ্বল; আর সবাই তো এই কেবল সংসার ছেড়ে পৃথিবীতে বেরিয়েছে তারা তো ভয় পাবেই।
তার গা কাটা দিয়ে উঠেছিল তখন। সারাটা পথ সে আগলে বসেছিল বউটাকে।
আজো চুপ করে বসে থাকলে একেক সময় শ্রুতির ভেতরে সেই বউটার বুক ফাটানো যন্ত্রণার কান্না তাকে দোজখে নিয়ে যায়।
আলীচাচার কথা সেদিন মিথ্যে বলে মনে হয়েছিল তার। মনে হয়েছিল এ পৃথিবীতে স্বর্গ হবে না, যে স্বর্গের কথা আবাল্য তাকে শিখিয়েছে আলীচাচা।
অনেকদিন পরে আলীজাহ্কে এই ঘটনাটা লিখেছিল জরিনা; আলীজাহ্ তখন লাহোরে। উত্তরে আলীজাহ্ লিখেছিল–তুই একটা বোকা, জরিনা। এ নিয়ে মন খারাপ করবার কী আছে? মানুষ তো পশুই–তাই বলে যারা স্বর্গ সৃষ্টি করতে চায় তারা সে পশুত্বকে দেখে ভয় পাবে কেন? তোর ঘটনাকে বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। তুই তখন ট্রেন থামাতে বাধা দিয়েছিলি কেন? বাধা দিয়েছিলি এইজন্যে যে, তাহলে পশুদের হাতে নিজেকে তুলে দিতে হতো। একজন যখন পুলিশ ডাকবার পরামর্শ দিয়েছিল, তুই মনে মনে তখন নিশ্চয়ই হেসেছিলি, আমি কল্পনা করতে পারছি। কেননা কী হবে শক্তি ডেকে? শক্তি চিরকালই দুর্বল। শক্তি দিয়ে পৃথিবীর বিহিত করা গেলে, মানুষ আত্মার সাধনা না করে কাঁচা শক্তির সাধনা করত যে।
যে মানুষগুলো চুনের পানি ছুঁড়ে মেরেছিল, ওদের আসনে বসিয়ে বিগ্রহ ছুঁইয়ে সত্যি কথা বলতে বল– দেখবি ওরা যা করেছে তাতে অন্তরের সায় ছিল না। তবে কেন করেছে? কেননা পৃথিবীর প্রায় সব মানুষই অন্তরের সায় না নিয়েই কাজ করে। যদি মানুষ একবার ভাবতে পারত তার অন্তরকে কী স্পর্শ করছে, আর কী করছে না, যদি মানুষ সেই ভাবে বাঁচতে পারত, তাহলে এত অন্যায় অসঙ্গতি সব ইতিহাসের পাতাতেই বন্দি থাকত, বর্তমানে এসে বর্ধিত হতো না, ভিড় জমাতো না।
বউটার চোখ অন্ধ হয়ে যাওয়াকে আমি প্রতীক হিসেবে নিলাম। তুইও তাই নে। মনে কর, দীপ্তি থাকে না বলেই তো দীপ্তির সন্ধান চলছে আমাদের।
আজ এই বৃষ্টির মুহূর্তে নতুন করে তার মনে হলো, আমি তো আলো আমার মুখে নেবার সাধনা করে চলেছি, আমি কেন কাঁদবো? মানুষের নিচতা দেখে হাত–পা সেঁদিয়ে আসবে কেন আমার?
মনে মনে এত মনে পড়ছিল আলীজাহ্ কথা। তাই বাবার মুখে আলীজাহ্ আসবার খবর পেয়ে সে কী উল্লাস হলো তার। সে সান্ত্বনার হাত যে এমনি অপ্রত্যাশিত এগিয়ে আসবে তা কে ভাবতে পেরেছিল? দুপুর থেকে তো, এই কথাই ভাবছিল সে–আজ যদি আলীচাচা থাকত ঢাকায়।
ভাববার কারণ ছিল বৈকি?
জরিনা উঠে কাপড় বদলালো, চুল বাঁধলো দ্রুত দুহাত। তারপর বাইরে বেরুবার জন্য চটি পরল যে চটি বৃষ্টি ভেজা রাস্তা থেকে কাদা তুলে মাখিয়ে দেবে না।
তাকে বেরুতে দেখে অবাক হলেন শাহ সাদেক আলী।
রোকসানা বলল, ওকে গিয়ে বলেছিলেন কী? রাগ করে বেরিয়ে গেল নাতো।
রোকসানার ভয় হলো বুঝি সাদেক তাকে গিয়ে বলেছে রেডিওগ্রামের ভল্যুম কমাতে তারই নাম করে। নইলে জরিনা একবারও তাকাল না কেন ফিরে?
সাদেক মৃদু হেসে বললেন, ঐ বয়সে আমরাও অমন করতাম না কি? আমি অত অবুঝ নই যে গিয়ে তোমার নাম করবো।–আমাকে আর একটু চা দাও।
বলতে বলতে সাদেক টেনে নিলেন সদ্য লেখা বিবৃতিটা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে লাগলেন। চোখের সমুখে যে জলজ্যান্ত একটা মানুষ বসে আছে এবং মানুষটা যে তাঁরই স্ত্রী একথা যেন তিনি সম্পূর্ণ বিস্মিত হয়ে গেছেন।
রোকসানা তাঁর কাপে চা ঢেলে দিয়ে পেয়ালাটাকে সমুখে রেখে তখন উঠে গেলো। উঠে গিয়ে শোবার ঘরে বসলো। বসে বসে ভাবতে লাগল নতুন বাড়ির কথা। তার সারা জীবনের স্বপ্ন নিজের একটা বাড়ি। বাড়িটা শেষ অবধি হলো তাহলে। আর কদিন পরে। যখন তারা গিয়ে উঠবে তখন–সেই তখনের স্বপ্ন লাগল রোকসানার চোখে মুখে।
পথে তো বেরুলো, কিন্তু যাবে কোথায়? বৃষ্টির পর সারাটা পথ কেমন বিশ্রী হয়ে আছে। কিন্তু আকাশ দেখাচ্ছে অপরূপ — ধোওয়া ধোওয়া, স্বচ্ছ, ভালো। আকাশে অমন সুন্দর রঙটা যেন খোদা এইমাত্র সৃষ্টি করলেন– এমনটি কোনদিন ছিল না, কোনদিন আর আসবে না।