তখন দরোজা খুলে জরিনা দেখল বাবাকে।
কী বাবা?
জরিনাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে নিজের কাছেই যেন নিজে লজ্জিত হলেন সাদেক। বললেন, তোর কি শরীর খারাপ করেছে?
নাতো।
জরিনা বাঁ–হাতে চুলের প্রান্তভাগ সামলাতে সামলাতে উদ্বিগ্ন চোখে তাকাল তার দিকে। বলল, কিছু বলবে?
রোকসানা ভল্যুম কমাতে বলেছে, কথাটা বলতে সাদেকের কুণ্ঠাবোধ হলো। পরে হঠাৎ উৎসাহের সঙ্গে উচ্চারণ করলেন–কেননা তার মনে পড়ে গেছে, আলী লাহোর থেকে আসছে আজ। তার করেছে।
কখন?
সন্ধ্যের প্লেনে। যাবি এয়ারপোর্টে?
বলেই সাদেক আর দাঁড়ালেন না, এমনকি একটু আগে যে মেয়ের সঙ্গে বসে চা খাবেন সিদ্ধান্ত করেছিলেন, সেটাও ভুলে গেলেন বলতে।
জরিনা ফিরে এলো ঘরের মাঝখানে। এক মুহূর্ত তার শ্রুতি বধির হয়ে রইলো–কোনো সঙ্গীত সেখানে তুলতে পারল না তরঙ্গ।
আলীচাচা আসছেন।
যেন পৃথিবীর একটা পরম আশ্চর্য সংবাদ শুনেছে সে। ঠিক তার জীবনের এইসব মুহূর্তগুলোতেই আলীচাচার মুখ কেন এমনি করে ভেসে উঠবে? আজ সে ভাবছিল কার কথা? আলী চাচার কথা। আজ তার একটু আগেই না মনে হচ্ছিল তার এই আপনতম লোকটার কথা? যার সহানুভূতির অমৃত আঁজলা ভরে সে পান করতে পারে।
জীবনের যে সমস্ত দুঃসময়ে তার মনে হয়েছে নিচে মাটি নেই আর সমুখের দিগন্ত গাঢ় অন্ধকার তখন মরে যাবার কথা মনে হয়নি। মনে হয়েছে তার শৈশবের কথা, কৈশোরের কথা, মায়ের চ্যাপ্টা কাঠপুতুলের মুখ আর আলীজাহ্ কথা। আলীজাহ্ বলেছে, একমাত্র হৃদয়কে যা স্পর্শ করে তাই–ই সত্য। হৃদয়কে তখন স্পর্শ করতে অতীতের মুখগুলো যা সত্য; হৃদয়কে তখন স্পর্শ করতে নিজের মনোবল যা সত্য; হৃদয়কে তখন স্পর্শ করতে পৃথিবীর অফুরন্ত ব্যঙ্গ—যা সত্য, কিন্তু তেতো।
একবার শুধু তার মনে হয়েছিল আলীচাচার কথা মিথ্যে, যেদিন ঐ ঘটনাটা ঘটেছিল। কলকাতা থেকে ঢাকা আসছিল ওরা তখন। রেলে গিজগিজ ভিড়। আপার ক্লাশ আর লোয়ার ক্লাশে কোনো তফাৎ নেই তখন। টিকিট একটা থাকলেই হলো। তারপর যে কোনো ক্লাশে ওঠা; গাড়ি পাকিস্তানে যাবে।
ট্রেন ছুটে চলেছে অন্ধকার ভেদ করে। আলীজাহ্ সাদেককে কলকাতা থেকে ভালো জায়গা করে তুলে দিয়েছিলো। বাঙ্ক রিজার্ভ করা ছিল তার জন্য–একটা ব্রাঙ্কে তিনজন যাত্রী, তবু সুবিধে। আর শেষ অবধি হুটোপুটির ভেতরে, বুক কাঁপানো গাড়ির ঘণ্টার শব্দের ভেতরে, টালমাটাল পায়ে অন্ধের মতো নূরুন্নাহার আর জরিনা গিয়ে উঠেছে তৃতীয় শ্রেণীর মহিলা কামরায়।
কামরার ভেতরটা যেন লালচে আলোয় বিভৎস হয়ে উঠেছে আরো। একে মানুষ, ট্রাঙ্ক, তৈজসপত্র, বাচ্চা–কাচ্চা–তার ওপরে ভ্যাপসা গরম। বাচ্চাদের চিৎকারে থেকে থেকে বুকের ভেতরে ছাৎ করে ওঠে, যে এখনি মরে যাবে কেউ। এরি ভেতরে বিলাপ করছে কেউ, কী জিনিস–পত্ৰ আগলে আছে রক্তচোখে।
বুকের ভেতরে ভয় ভয় করছিল দুবোনের। জনাির মনে হচ্ছিল যেন সৃষ্টির আদি থেকে সে এখানে গাড়ির ভেতরে জন্ম নিয়ে এতটা বয়স অবধি পার হয়ে এসেছে। মনে হচ্ছিল, এই বর্তমানই সত্য, বর্তমানেই সব। আর পেছনে যে অতীত, সমুখে যে ভবিষ্যৎ দুইই কোনদিন ছিল না, থাকবে না।
তাই তীব্র করে সে অনুভব করতে পারছিল বর্তমানের প্রতিটি তরঙ্গ।
নূরুন্নাহার অনেকক্ষণ জেগে থেকে থেকে এককোণে চুলতে শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু ঘুম নেই জরিনার চোখে। যেন ঘুম বলে কোনদিন কিছু তার জানা ছিল না।
একটা করে স্টেশন আসে আর মৃদু গুঞ্জন ওঠে ট্রেনে ওঠে আরো নতুন যাত্রী। জায়গা নেই, তাতে কী!
একটা রাতের মত ট্রেনের কষ্ট সইতে পারেন না আপনারা?–জানালা দিয়ে গলা ঢুকিয়ে স্বেচ্ছাসেবকরা অনুনয় করে। আপনাদেরই মা বোন যাচ্ছেন, আপনারা একটু কষ্ট করুন, পাকিস্তান আসবার আর বাকি নেই।
আর বাকি নেই? আর কত দূর?
আবার ট্রেন চলতে থাকে।
তখন রাত দুপুর। কী একটা স্টেশনে গাড়ি থেমেছে। কচি একটা বউ উঠলো তাদের কামরায়– ভীত, সন্ত্রস্ত। সঙ্গে তার ততোধিক ভীত, সন্ত্রস্ত স্বামী। আর একজন বুড়ি–মা হবেন হয়তো।
স্বামীটি নেমে গেল। বুড়ি বসে পড়ল মেঝেয়। আর বউটা ডাগর চোখ মেলে ভয়ে ভয়ে তাকালো। তখন জরিনার চোখ পড়ল তার দিকে। কী সুন্দর তার চোখ; মনে হলো জরিনার, অমন একজোড়া চোখ থাকলে কিছু দরকার নেই আর। শুধু চোখ দিয়েই দেয়া যায়, নেয়া যায়, ভরে ওঠা যায়।
নিজের মুখের জন্য আপশোষের অন্ত ছিল না জরিনার। বসে বসে খুঁত বের করা ছিল তার কৈশোরের একটা সময় কাটানোর উপায়। মনে মনে গাল দিত খোদাকে, যিনি তাকে নিখুঁত চেহারা দেন নি, যিনি কপালটাকে অহেতুক চওড়া করে দিয়েছেন, চোখ যথেষ্ট টানা করে। দেন নি, আর চিবুকের নিচে যথেষ্ট জায়গা ছেড়ে না দিয়েই শেষ করে দিয়েছেন, তাই সুন্দর মুখ চোখে পড়লে, জরিনা চিরকাল তার জন্য বুকের ভেতরে টান অনুভব করেছে।
জরিনা বউটিকে ডেকে নিল কাছে। বসবার জায়গা নেই। কোলের কাছে বসালো তাকে। নিজের অসুবিধে হলো, কিন্তু ভালো লাগল। শুধালো, পাকিস্তান যাবেন?
বউটা তার দিকে তাকিয়ে ঘাড় কাৎ করলো। মুখে কিছু বলল না। তারপর বউটা জানালার ওপর মুখ রেখে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে রইল।
গাড়ি ছেড়ে দিল। গতি কেবল এসেছে কী আসে নি, প্লাটফরম তখনো পেরিয়ে যায়নি, আজো স্পষ্ট মনে আছে জরিনার তখন বাইরে অন্ধকারের ভেতর এক ঝলক উষ্ণ তরল কী এসে ছিটকে পড়ল তাদেরই কামরায় তারই জানালা দিয়ে। বউটার চোখে মুখে জরিনার পিঠে এসে পড়েছে। চমকে জরিনা তাকিয়েছে জানালার দিকে। আর বউটা আকস্মিক রকমে চিৎকার করে উঠেছে যন্ত্রণায়, আর্তনাদে খানখান করে ফেলেছে দুধারের বয়ে যাওয়া। হুহু বাতাস।