জরিনা আরো একটু কাছে এসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল সব। হঠাৎ নিজেকে খুব ছোট মনে হলো তার। আলীজাহ্ ওপর রাগ হলো। রাগ হলো ওই তিনটে মহিলার ওপর। মনে হলো, এক্ষুণি সে যদি চিৎকার করে উঠতে পারত না, চিৎকার নয়–এখন যদি ফিট হয়ে যেতে পারত, তাহলে খুব শাস্তি হতো ওদের। কিন্তু বহুবার জরিনা দেখেছে, যা চাওয়া যায় তা হয় না।
তাই কিছু বলবে না সে ওদের। সরে এসে এদিকের একটা থামের আড়ালে নিজেকে ঢেকে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল জরিনা। দাঁড়িয়ে পা সমুখে টেনে কোমর থেকে গোড়ালি অবধি একটা টান টান আবছা ধনুক সৃষ্টি করে রইলো।
৪. যুদ্ধের দ্রুত কলকাতা
যুদ্ধের দ্রুত কলকাতা।
বেরিয়ে এসে গাড়িতে বসে জরিনা বলেছিল, এখুনি সে বাসায় ফিরবে না। ঘুরে বেড়াবে। এসপ্ল্যানেড দিয়ে গাড়ি ছুটছে। ড্রাইভ করছে আলীজাহ্ আর জরিনা পাশে বসে।
অন্ধকার আকাশের নিচে কলকাতায় যেন অসংখ্য আলোর নৃত্য চলেছে। চকোলেট, র্যাপার, চুয়িংগাম আর ইউনিফর্মড হোয়াইটস। এত রাতে শহরে সে আর কোনদিন এমনি লক্ষ্যহীন ঘুরে বেড়ায়নি। আলীজাহ্ উদার দুহাত থেকে সে আজ মূল্যবান উপহার পেয়ে গেছে।
আর সমস্ত কলকাতা যেন শূন্য, বিস্তৃত, বিশাল একটা পটভূমি যেখানে এতকাল কিছুই হয়নি; আজ সেই পটভূমিতে নানা রঙের আলোর রেখা–দীর্ঘ এবং বিন্দু বিন্দু–আলোর বৃত্ত অবিরাম জ্যামিতির জ্বলন্ত নকসা এঁকে চলেছে। আর তাই দেখতে মানুষ ভিড় করেছে, অস্থির তাড়া খাওয়া মানুষ এখানে ওখানে ময়দানে, চৌরঙ্গিতে। একটা কটু কিন্তু মিঠে মিঠে জন্মান্তরের চেনা জ্বালাকর ঘ্রাণ বাতাসে গাড়ির দুপাশ দিয়ে হুহু করে বেরিয়ে যাচ্ছে। জরিনা নড়েচড়ে বসলো। আলীজাহ্ শুধালো, কিরে আরো বেড়াবি?
হুঁ।
মোমাছির গুঞ্জনের মতো হেসে উঠলো আলীজাহ্।
তার পায়ের চাপে দ্রুত উদ্দাম হয়ে উঠল গাড়িখানা। সমস্ত অস্তিত্ব থরথর করে কাঁপতে থাকে যেন আবেগে। জরিনার মন আশ্চর্য রকমে হালকা হয়ে যায়। অপূর্ব একটা খুশিতে টলমল করে ওঠে। আলীজাহ্ তার কানের কাছে মুখ নামিয়ে এনে বলে, চল দমদমের ওদিক ঘুরে আসি।
জরিনার দুই করতল তালি হয়ে উঠতে চায় আনন্দে, গতিতে, মুক্তিতে। সেই পার্টির কথা এখন তার একটুও মনে পড়ছে না। দিগন্তের আড়ালে দ্বীপের মত তলিয়ে গেছে যেন সবকিছু।
বাসায় যখন ফিরে এলো তখন বেশ রাত হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়েছে সবাই। কেবল আলো জ্বলছে সাদেকের স্টাডিতে। আলীজাহ্ বলল, আব্বা পড়ছেন। ইস্ মেলা দেরি হয়ে গেল, নারে?
গ্যারেজের তালা খুলে আলীজাহ্ গাড়িটাকে এগিয়ে পেছিয়ে কাটিয়ে ভেতরে ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, কেমন লাগল বল এবার।
ভালো।
কী ভালো?
জরিনা বুঝতে পারল না তার প্রশ্ন! তাকিয়ে রইল।
জন্মদিনের সেই মেয়েটিকে কেমন লাগল তাই জিগ্যেস করছি। খুব সুন্দর করে সাজতে পারে, কথা বলতে পারে, না?
হ্যাঁ–জানো আলীচাচা, আমাকে রোজ যেতে বলেছে।
কোথায়?
আলীজাহ্ বিস্ময়ে মুখটাকে প্রকট করে তোলে।
ওর ওখানে।
যাবি, বেশতো।
তোমার সঙ্গে যাবো। তোমাকে ওরা সবাই চেনে, না আলীচাচা?
আলীজাহ্ হাসলো অনেকক্ষণ ধরে।
গাড়ি ততক্ষণে গ্যারেজে ঢুকে গেছে। বেরিয়ে এসে আলীজাহ্ দরোজা বন্ধ করতে লাগল। জরিনা তার দুহাত দিয়ে দরোজার অন্য পাল্লা টেনে এনে ভিড়িয়ে দিল।
বাহ, খুব কাজের হয়েছিস তো। হাতে ব্যথা পেলি নাকি?
নাহ।
পরিশ্রমে, প্রশংসায় লাল হয়ে ওঠে জরিনার মুখ।
এই–ছি, ছি, সরে দাঁড়া জরিনা।
জরিনা চকিতে নিচে তাকিয়ে দেখে গ্যারেজের সমুখে সরু নালাটায় একটা ইঁদুর মরে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। জরিনা মনে মনে শিউরে ওঠে– এ র্যাট, এ ডেড র্যাট। আর এ টি–র্যাট।
আলীজাহ্, জরিনার হাত ধরে বাসার ভেতর যেত যেতে বলে, ড্রাইভার কদিন হলো যা ফাঁদ পেতে রেখে গ্যারেজের চারদিকে। কটা মরলো কে জানে?
বড্ড বিশ্রী, আলীচাচা।
সেদিনের মতোই দুটো করে সিঁড়ি একসাথে ভাঙতে থাকে জরিনা। আলীজাহ্ একটা তালি দিয়ে বলে, আজ তিনটে করে জরিনা। পারলে তোকে তোকে একটা শাড়ি কিনে দেব। খুব দামি শাড়ি। লাল টুকুটুকে, রেশমি।
জরিনার সমুখে ক্রীমঙ্গা দেয়ালটা যেন হঠাৎ লাল হয়ে জ্বলে ওঠে– সংগীত হয়ে রিমঝিম করতে থাকে।
এর ঠিক পাঁচদিন পরে আলীজাহ্ বম্বে চলে গেল ছবির কাজ পেয়ে। জরিনার তখন কান্না পেল। তিনদিন ধরে খাতার পৃষ্ঠায় বড় বড় করে চিঠি লিখলো বাঁকা হাতের লেখায়। তারপর কখন যে সেই পৃষ্ঠাগুলো অনাদরে অযত্নে কোথায় পড়ে রইলে তা জরিনা নিজেও জানতে পেল না।
.
শাহ সাদেক আলী জরিনার কামরার কাছে এলেন। এসে দেখলেন দরোজা বন্ধ। ভেতরে রেডিওগ্রামের ভল্যুমটা এত ওপরে ওঠানো যে ডাকলে তার স্বর গিয়ে পৌঁছুবে কী না সন্দেহ।
মেয়েটি তার এমনি, মনে মনে ভাবলেন তিনি, বিব্রত হয়ে, খানিকক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থেকে। কিছু বোঝা যাবে না, নিশ্চিত করে কিছু বলা যাবে না তবু যেমন বুঝতে পারলেন তিনি, কোথায় কী একটা ধাক্কা লেগেছে আজ জরিনার মনে যেটা ভুলবার জন্য চলেছে এই আয়োজন।
এমন ছোটখাটো ঘটনা বহু দেখেছেন সাদেক আলী। দেখেছেন জরিনাকে কষ্ট পেতে। দরোজায় করাঘাত করলেন তিনি। কিন্তু সে শব্দ নিজের কানেই শোনা গেল না। আবার তিনি হাত তুললেন। এবারে আরো একটু জোরে। তবু শোনা গেল না। হঠাৎ ভীষণ জোরে আঘাত করলেন দরোজায়। শাহ সাদেক আলীর গৌর মুঠিতে রক্তিমতা ফুটে উঠলো! ব্যথা করল।