লনের মাঝামাঝি চেরা–সিঁথি পথ গেছে বারান্দার দিকে। গাড়ি থেকে নেমে আলীজাহ্ জরিনাকে হাত ধরে নামালো। তারপর কাঁধে তার বিশাল করতল রেখে বলল, স্মিত মুখে, নিচু গলায়, এখানে।
জরিনা আলীজাহ্ দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফেরাল সমুখে। সমুখে এক দম্পতি–তারাও যাচ্ছিল বাবান্দার দিকে, পরস্পর নিবিড় হয়ে। লোকটার বাঁ হাতে মহিলাটির মুঠো। আর তার খোঁপার বন্ধনমূলে চাঁদের মতো আধখানা বেরিয়ে আছে শাদা ফুলের মালা।
জরিনার ভালো লাগল তার চলার ছন্দ। সে একবার চোর–চোখে তাকাল আলীজাহ্ দিকে। আস্তে আস্তে কাঁধ থেকে সরিয়ে দিল আলীজাহ্ করতল। তারপর মুঠো করে ধরলো। আলীজাহ্ তর্জনী আর মধ্যমা।
বারান্দার সিঁড়ির ওপরে যে মেয়েটি দাঁড়িয়েছিল– জরিনা তাকে দূরে থেকেই দেখেছিল দীর্ঘ, ফর্সা, লাল উজ্জ্বল পাড়হীন শাড়ি পড়া, সে আলীজাকে দেখে সুন্দর একটা ভঙ্গিতে এক ধাপ নেমে এসে কলকণ্ঠে বলে উঠল, আসুন, ইস, এত দেরি। তারপর জরিনাকে দেখে, জরিনার চিবুক স্পর্শ করে বলল, ঝুঁকে পড়ে, কী নাম?
জরিনা আবছা গলায় উত্তর করল তার। মেয়েটি মুখ সরিয়ে নিতেই জরিনার এক মুহূর্তের মেঘ কেটে গেল অন্ধকার ঘরে বিজলি বাতি জ্বলে ওঠার মত। যে লাল শাড়ির ঔজ্জ্বল্য খুব কাছাকাছি এসে তার দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন। করেছিল তা অপসারিত হলো। সে তখন সম্পূর্ণ করে তাকে দেখল, মুগ্ধ হলো।
আলীজাহ্ বললো, এরই জন্মদিন। বুঝলি?
জানি।
আলীজাহ্ তাকে নিয়ে এগিয়ে গেল আরো ভিড়ের ভেতর। আলীজাহ্ উপস্থিতিতে হঠাৎ যেন মৌমাছি হয়ে উঠল সবাই। জরিনা তাকিয়ে দেখে। তার গর্ব হয়। তার আলীচাচা, এ যেন তারই অহংকার। আলীজাহ্ আঙুল ধরে নিবিড় হয়ে সে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে।
এত সুন্দর মানুষের ভিড়। কাপড়ের, ফুলের, শাড়ির গন্ধ। আর মানুষের গাত্রসৌরভ। আর কণ্ঠস্বর। আর আলো। তার আশ্চর্য লাগে। স্বপ্ন থেকে উঠে আসা কোনো মুহূর্তের মতো মনে হয়।
জরিনাকে গিয়ে আলীজাহ্ নিয়ে বসল একটা সোফায়। আলীচাচাকেও আজ তার কী দীর্ঘ মনে হচ্ছে। চারদিকের এত কোলাহল, গতি, কথা, কিছুই তার চোখে পড়ছে না। কিছুই সে শুনছে না, নিতে পারছে না আলাদা করে কোনো কিছুই। সব কিছু এক হয়ে তার মনের ভেতরে এঁকে যাচ্ছে একটি মাত্র ছবি।
পাশ থেকে নরোম একটা হাতের স্পর্শে জরিনা তাকিয়ে দেখল যার জন্মদিন সেই লাল শাড়ি পরা মেয়েটি এসে দাঁড়িয়েছে। এতক্ষণ সে বারান্দা আর ড্রইং রুমের একোণ থেকে ওকোণ অবধি ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কখন এসে দাঁড়াল তার পেছনে? মেয়েটি গ্রীবা বাঁকিয়ে সুরেলা গলায় শুধালো, কেমন?
জরিনা কী করবে ভেবে উঠতে পারল না। ও তাকে এতখানি মুগ্ধ করেছে যে ওর সমুখে কেমন ভেতর থেকে সব কিছু সঙ্কুচিত হয়ে আসছে।
আলীজাহ্ তার কনুইয়ে ঠেলা দিয়ে বলল, যা না।
বাবা, আপনি যা কথক মানুষ আর তার ভাইঝি এমন?
তাহলে তুমি ওকে চিনতেই পারো নি। আলীজাহ্ বলল জরিনার দিকে মুখ আধো নামিয়ে, আমার সঙ্গে যা গল্প করে তুমি যদি শুনতে।
হবে না। আপনারই ভাইঝি তো।
বাহ্, আগেও দোষ পরেও দোষ। বেশ তো।
মেয়েটি কাঁচভাঙ্গার অনুকরণে হেসে উঠলো কথা শুনে।
ঠিক তখন কারা দুজন এদিকে আসছিল আলীজাহ্কে দেখে, আলীজাহ্ উঠে দাঁড়াল। কথা বলতে লাগল। নাটকের কথা, ফিল্মের কথা, অনেকের কথা, যাদের জরিনা চেনে না।
জন্মদিন–মেয়েটি তখন তার পাশে এসে বসলো। জরিনাকে কাছে টেনে নিয়ে, এত ভাল লাগল তার তখন, সে বললো, লক্ষ্মী মেয়ে তুমি, কী পড় বললে না? কোন স্কুলে?
স্কুলের নাম বলল জরিনা। হঠাৎ হালকা হয়ে গেল তার বুকের ভয়টুকু। সে কথা বলতে লাগল –অনর্গল, দ্রুত, চোখ হাত নেড়ে, নাচিয়ে?
বাহ, চাচার কাছে থেকে তুমিও বেশ কথা বলতে শিখেছ। চাচা তোমাকে অ্যাকটিং শেখাবে না?
আমি শিখব না। ভালো লাগে না।
তাহলে কী শিখবে? হোয়াট ইউল বি?
আলীজাহ্ কথা বলতে বলতে দূরে সরে যাচ্ছে। জরিনা সেদিকে এক পলক তাকিয়ে দেখে উত্তর করল, আপনি পারেন?
কী?
অ্যাকটিং।
একটুকুও না।
আলীচাচা এত সুন্দর করতে পারে।
তুমি দেখেছ?
ক–ত।
আলীজাহ্ আরো দূরে সরে গেছে। ঠাৎ জরিনা প্রশ্ন কবে, আপনার জন্মদিন আবার কবে হবে?
ওমা কেন?
মেয়েটি বিস্ময়ে ঠোঁট গোল করে আনে। চোখের মণি একটা সুন্দর ভঙ্গিতে স্থির হয়ে থাকে।
আমি আসবো।
তুমি এমনি আসবে। রোজ আসবে, কেমন?
জরিনার লজ্জা কবে। ঘাড় কাৎ করে উত্তর দেয়। একটু পরে মেয়েটি বলে, তুমি বসো, আমি এই আসছি।
কিন্তু অনেকক্ষণ হয়ে যায় আর আসে না। মনটা প্রথমে উদগ্রীব হয়ে থাকে, পরে আস্তে আস্তে আস্তে নিভে যায়। তখন ম্লান চোখে দৃষ্টি করে ইতস্তত।
আলীজাহ্ও নেই।
একটু পরে জরিনা উঠে দাঁড়ায়। এদিকে ওদিকে তাকাতে থাকে। একটা ছোট্ট দলের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে। কারো চোখে পড়ে না। জরিনা এগোয়, এতক্ষণে আলীজাকে সে দেখতে পেয়েছে।
দূরে, বারান্দার একেবারে শেষ মাথায়, কয়েকটা সবুজ পাতা গাছের সঙ্গে পিঠ ছুঁইয়ে আলীজা দাঁড়িয়ে আছে। আর তার সমুখে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে তিনজন মহিলা। কী কথা বলছে কে জানে। এতদূরে থেকে ওদের হাসি ছড়ানো মুখ শুধু চোখে পড়ে। আলীজাহ্ ঝুঁকে পড়ে ডান হাতের তর্জনী দুলিয়ে একজনকে অনেকক্ষণ ধরে কী যেন বলছে। বলা শেষ হলো। হেসে উঠল সবাই।