জরিনা যেন জানে, যদিও সে কোনদিন কোন জন্মদিনের পার্টিতে যায়নি–এখানে থাকবে না ব্যস্ত মানুষের আনাগোনা। থাকবে আলো, রঙিন বাতি আর সুখী, সুগন্ধ ছড়ানো মানুষ যেমন সে ছবিতে দেখেছে। এমন কি খুব ধূসর করে মনে পড়ল সেই কয়েকটা মহিলার মুখ যারা নূরু আপাব বিয়েতে এসেছিল এপাড় ওপাড়া থেকে যাদের কয়েকজনকে কী ভালো লেগেছিল জরিনার। তার রক্ত চঞ্চল হয়ে উঠলো তাদের কথা মনে করে। সে ভাবলো কাল পার্টিতে তারাও হয়ত আসবে। আবার সে দেখতে পাবে ওদের।
একটু পরে হঠাৎ দপ করে সব নিভে গেল। খাবার টেবিলে ম্লান মুখে সে বসে রইল খানিক। তারপর চিবুক তুলে আলীজাহ্ দিকে তাকালো। আলীজাহ্ কী বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ ওর দিকে তাকিয়ে শংকার ছায়া মেশানো কণ্ঠে শুধালো, কী হয়েছে?
মাঝে মাঝে এমনি নিভে যেতে সে দেখেছে জরিনাকে। জরিনা মাথা নাড়ে। মুখে বলে, কাল কখন যাবে?
বিকেলে। বিকেল ঠিক সাড়ে পাঁচটায়।
আলীজাহ্ হালকা গলায় উত্তর করে, এবং চোখে প্রশ্ন নিয়ে তবু তাকিয়ে থাকে জরিনার দিকে।
একটু পরে জরিনাই প্রশ্ন করে, আচ্ছা আলীচাচা, জন্মদিন কেন?
প্রশ্নটা চট করে আলীজাহ্ বুঝতে পারে না। পরে বলে, বয়স একটা বছর বাড়লো সেই কথাটা মনে রাখবার জন্যে। যেমন তুই দিনে দিনে বড় হচ্ছিস, একদিন আর ছোট থাকবি না, তেমনি।
তাহলে সবাই কেন যাবে?
এ প্রশ্নটাও আলীজাহ্ বুঝতে পারে না। জরিনার দিকে গভীর চোখে খানিক তাকিয়ে থাকে। খুব আস্তে একটু পরে উত্তর করে, তুই আমি সবাই যাবো, সারাটা জীবন যেন তার সুন্দর করে কাটে, এই ইচ্ছে নিয়ে।
তবু তার মনে হলো যেন যথেষ্ট বলা হলো না। তাই সে আবার গোড়া থেকে শুরু করলো, যে মাসের যে তারিখে জন্ম, সেই মাস সেই তারিখ প্রত্যেক বছরে ফিরে আসে। তার মানে আমরা এক বছর বড় হই, একটা বছর পেরিয়ে আসি। এমনি করে সারা জীবন।
আলীজাহ্ নিজের কাছেই কথাগুলোর অর্থ খুব স্পষ্ট হয় না। সে ভাবতে থাকে আর কী বলা যেতে পারে। জরিনা অন্যমনস্ক হয়ে শুধোয়, তারপর একদিন মরে যাবে, না? জন্মদিনে কেউ মরে যায় না আলীচাচা?
আলীজাহ্ চকিতে চোখ তুলে তাকে দেখে নেয়, পরে দ্রুত সারামুখে হাসি ছড়িয়ে বলে, ও, এইকথা। এইসব ভাবছিলি এতক্ষণ? মানুষ তো মরে যায়ই, জন্মদিনেও মরে যায়। জন্মদিনে যারা মরে তারা ভাগ্যবান।
কেন?
হঠাৎ বিব্রত হয়ে পড়ে। তাইতো? কেন? বলে, মানে, তাদের আর ভাঙ্গতি হিসেব করতে হয় না। শুধু বছরের হিসেব, তাই। চট করে বলে দেয়া যায় এত বছর বয়সে উনি মারা গেলেন। আর অন্যদের কত অসুবিধে। বলতে হবে, কত বছর, কত মাস, কদিন। তাই না?
তুমি কাউকে মরে যেতে দেখেছ, আলীচাচা?
দেখেছি।
কাকে?
আলীজাহ্ মনে পড়ে জরিনার মার কথা। বলে, তুমি চিনবে না। কেন?
জরিনা আবার থুতনি টেবিলে নামিয়ে আনতে আনতে বলে, এমনি। মা যখন মরে গেল আমি ইস্কুলে। আমি দেখিও নি। আবছা আবছা জরিনার মনে পড়ে শাদা চার দেয়াল হাসপাতালের কামরা আর মার শরীরে টেনে দেয়া ভারী চাঁদরটার কথা।
কেমন করে মরে যায় আলীচাচা?
অসুখে।
তারপর?
তারপর– মরে যায়। আত্মা আকাশে চলে যায়।
জরিনা একটু ওপরে তাকায়। পরে চোখ নামিয়ে এনে শুধোয়, কেমন করে? তুমি তো দেখেছ বলো না।
সব কিছু হারিয়ে যেতে থাকে তখন এই আলো, গাছ, মানুষ–সব কিছু। সবচেয়ে বড়ো যে হারিয়ে ফেলা, সেটাই জীবন। যখন সময় হয়, তখন মানুষের মন খুব উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সব কিছু দেখতে চায়, ধরতে চায়, ধরে রাখতে চায়, কিন্তু পারে না। আস্তে আস্তে আকাশের আলো সন্ধ্যের মতো হয়ে আসে। বৃষ্টি হলে যেমন দূরের সব কিছু ঝাঁপসা হয়ে যায়, তেমনি সব ঝাঁপসা হয়ে মিশে যায়। কাউকে দেখতে পায় না। বুকের ভেতরে নিঃশ্বাস কাঁপতে থাকে। আঙুলের ডগা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। তখন খুব ক্লান্ত লাগে। তখন আর কিছু মনে থাকে না। তখন মানুষ মরে যায়।
জরিনা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তার মনে হয়, মানুষ মরে না গিয়ে বেঁচে থাকতে পারে না? একটা চারদিক বন্ধ বড় কাঁচের বেলুন যদি সে পেত, তাহলে তার ভেতরে গিয়ে বসে থাকত, উঠে যেত আকাশের অনেক ওপরে। তাহলে হয়ত সে কোনদিন মরে যেত না। বহুদিন অনেকদিন সে বেঁচে থাকতে পারতো।
আলীজাহ্ উঠে দাঁড়িয়ে রোজকার মতো তার চুলে আঙুল দিয়ে ব্রাশ করে, নাড়া দিয়ে বলে, চল, আমার ঘরে যাবি। আজ ঘুমুলে চলবে না। নতুন রেকর্ড এনেছি, শুনবি চল।
আলীজাহ্ ওর মনের মেঘ দূর করতে চায়। সিঁড়ির নিচে এসে বলে, দুটো করে সিঁড়ি একবারে। পারবি?
খু–ব।
দেখি তাহলে। কুইক। হ্যাঁ, ওয়ান–টু থ্রি।
ওপরে উঠে জরিনা হাঁপাতে থাকে। হাতের পিঠ দিয়ে নাক ঘষে দম নিয়ে হেসে ফেলে।
নিচে আলীজাহ্ দিকে তাকিয়ে বা হাত নেড়ে বলে, তুমি কিন্তু তিনটে করে আসবে।
এসো।
আলীজাহ্ উঠতে থাকে। ভান করে, যেন তার খুব কষ্ট হচ্ছে। জরিনা আবার হেসে ওঠে।
.
বাড়িটা ঠিক যেমন ভেবেছিল তেমনি শাদা। সমুখে লন। আর মানুষ। আর বাতি খুব কম, এখানে ওখানে। তবু মনে হয়, কোথাও আলোর অভাব নেই এতটুকু।
জরিনা আর আলীজাহ্ যখন গাড়ি থেকে নামলো তখন প্রায় সবাই এসে গেছে। জরিনার পরনে শাদা সাটিনের কামিজ। কদিন আগে চুল ট্রিম করা হয়েছে কাঁধ অবধি; মাথার ওপরে একটা লাল টেপ বো করে বাঁধা। বেরুবার আগে আলীজাহ্ চেয়ারে বসে তাকে দুহাটুর মধ্যে এনে কপালের ওপরে ছোট ছোট চুলগুলো টেনে দিয়েছে, ঝালরের মত এখন তারা চুমু খেয়ে আছে তার চওড়া কপাল। জরিনার চোখ আবেগে উজ্জ্বল, তীক্ষ্ণ, আলীজাহ্ নিবিড় প্রীতিতে মন নির্ভয়।