সঙ্গে সঙ্গে আলীজাহ্ শরীরে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা দেয়। কুঁকড়ে এতটুকু হয়ে আসে শরীর, ডান হাত আর ডান পা সেই শরীর থেকে ঝুলতে থাকে অর্কিড লতার মতো। আর ছুরির মতো জ্বলতে থাকে দুচোখ। কাঁপতে থাকে চোয়াল। আলীজাহ্ দারুণ আক্রোশে সারা মেঝেয় তার দেহ টেনে টেনে চলতে থাকে। সংলাপ বলে। তার কিছুই কানে যায় না জরিনার। সে শুধু আলীজাহ্কে দেখে। আলীজাহ্ তার কাছে এগিয়ে এসে থমকে দাঁড়ায়। তখন অস্পষ্ট হয়ে আসে যেন তার মুখ! জরিনার মনে হয় সম্রাট শাহজাহান–দি এমপেরর হু বিলটু তাজমহল– তার সমুখে অতীত থেকে এসে দাঁড়িয়েছেন। সম্রাট তাকে অবলোকন করছেন ক্লান্ত দুচোখের পাতা তুলে। হয়ত চিনতে পারলেন না। কিংবা এতই তিনি আত্মমগ্ন যে তার উপস্থিতি তিনি অনুভব করতেও পারলেন না। জরিনা কাঠ হয়ে বসে রইলো। সম্রাট তখন পঙ্গু শরীরটাকে টেনে টেনে দূরে সরে গেলেন।
আলীজাহ্ স্পিংয়ের মতো শরীরটাকে ছেড়ে দিযে ডান হাত দুবার ঝেড়ে সমুখে এলো হাসি মুখে! তখন জরিনার শাদা মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, যেন এতক্ষণ তার হৃদস্পন্দন, তার রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে ছিল। বলল, ইস, এত সুন্দর তুমি করতে পারো।
তাই নাকি?
সত্যি।
হয়েছে হয়েছে। খেয়েছিস?
নিচে খাবার টেবিলে আলীজাহ্ উল্টোদিকে বসে টেবিলে থুতনি লাগিয়ে বসে থাকে জরিনা। আলীজাহ্ খেতে খেতে বলে, শাহজাহান কিন্তু ভাত খেত না। পোলাও দুবেলা পোলাও, রোস্ট, এইসব। বাদশাহ ছিল কিনা। আসল বাদশাহ, থিয়েটারের না।
জরিনা খিলখিল করে হেসে ওঠে। হাসিতে ভেঙ্গে পড়তে চায়।
আহ, পানির গ্লাসটা ফেলে দিবি যে।
জরিনা তখন থামে। পানির কথা ওঠায় গ্লাসের দিকে তাকিয়ে দেখে। তারপর নিজেই ঢকঢক করে খানিকটা পানি খেয়ে নেয়। একটু হাসে। সারাটা বাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছে। কোনোখানে কোনো শব্দ নেই। শুধু রাত। জরিনার মনে হচ্ছে যেন আজ হঠাৎ একটা ভারী খুশির খবর মিলেছে তার। আজ যা খুশি সে তাই করতে পারে।
শোবার ঘরে ঘড়িতে একটা বাজার ঘন্টা দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে মিলিয়ে গেল।
আলীজাহ্ হাত ধুয়ে বলে, একটা বাজলো না দেড়টা?–মেলা রাত হয়েছে তো। চল চল।
চোখ তো টেনে আসছে, তবু বসে আছিস!
সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে দুজন। এতক্ষণে ঘুম পাচ্ছে জরিনার। সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠবার সময় কেবলি পিছিয়ে পড়ছে সে। আলীজাহ্ তাকে কোলে তুলে নেয়। জরিনা তার গলা জড়িয়ে ধরে থাকে। তখন জরিনার আর কোন অনুভব থাকে না এই অতিবাহনের। মনে হয় এমনি করে দোতলা ছাড়িয়ে, সব দালান ছাড়িয়ে, ক্রমাগত সে কোমল একটা আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে। আলীজাহ্ গলা আরো ভাল করে জড়িয়ে ধরে সে।
.
এরপর থেকে এমন হলো, রোজ রাতে জেগে থাকতো জরিনা যতক্ষণ না আলীজাহ্ ফিরে আসে। তারপর দুজনে মিলে খাবার টেবিলে গল্প। জরিনার সমস্ত দিনের হাজার কথা আর কাজ, ভাবনা সব বলা চাই আলীজাকে। যে কথা সে বলতে পারে না সারাটা দিন আর যে কথা বলা যায় না তা নির্ভয়ে বলা যায় একমাত্র আলীজাকে। দিনের বেলায় যা চাপা থাকে, বিরূপ পৃথিবী থেকে যা সযতে লুকিয়ে রাখে জরিনা, রাতের এই মুহূর্তগুলোয় তা বেরিয়ে আসে আকাশের এই অত নক্ষত্রের মতো একে একে, ছোট ছোট, জ্বলন্ত। জরিনা অনুভব করতে পারে একটা নিবিড় যোগসূত্র। আলীজাহ্ তার কাছে একান্ত হয়ে ওঠে। কাউকে জানায় না সে রাতের এই মুহূর্তগুলোর কথা। সাদেক, রোকসানা কাউকে না। এ তার একান্ত, নিজস্ব।
সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন দুজনে খাবার টেবিলে, মুখোমুখি। মাথার ওপর জ্বলছে বালব। আলীজাহ্ যখন মুখ নিচু করে খেতে থাকে তার ছায়া এগিয়ে এসে পড়ে টেবিলের মাঝামাঝি। জরিনা একেকদিন, তখন সমুখে ঝুঁকে পড়ে নিজের ছায়া দিয়ে স্পর্শ করতে চায় ঐ ছায়াটাকে–আর কথা বলে। যেন রাত্রির নিবিড় থেকে উঠে এসে তারা দুজন একটা গোপন ষড়যন্ত্রে মিলিত হয়েছে। জরিনার তখন মনে হয়, এই টেবিলে এসে মুখোমুখি বসার মুহূর্তে, এখন থেকে যতক্ষণ তারা এখানে বসে থাকবে–এই বসে থাকা, এই ছোট ছোট হাসি, এই কথা, এই উষ্ণতা এটাই বাস্তব, আর সারাটা দিন, দিনের চলাচলে সমস্ত কিছুই স্বপ্ন মরে থাকা।
.
আলীজাহ্ সেদিন রাতে ফিরে এসেই বলে, কাল এক জায়গায় যাবি?
কোথায় আলীচাচা?
গেলেই দেখতে পাবি।
বলো না।
বলছি, বলছি। পাখাটা ছেড়ে দিই আগে, যা গরম পড়ছে আমার এক বান্ধবীর জন্মদিন কাল। পার্টি হবে। তোকে নিয়ে যাবো। যাবি?
হ্যাঁ। ঘাড় কাত করে জরিনা সম্মতি জানায়। পাখার বাতাসে মাথার চুল ফিনফিন করে উড়তে থাকে। মনটাও তার অমনি দ্রুত সচল হয়ে ওঠে। ছাদের ওপর একেকদিন দমকা বাতাসের মুখে জামা–কাপড় পেছনে পত পত করে উড়িয়ে ঠেলে ফেলে দিতে চায়, তেমনি অস্থির এখন তার কল্পনা। দুচোখে সে স্পষ্ট দেখতে পায় এক অজানা বিরাট বাড়ির সমুখে বাড়ির রঙ নিশ্চয়ই শাদা– সবুজ ঘাস চুলের মতো করে ছাঁটা লনে পার্টি হচ্ছে। বাবার সঙ্গে সে কয়েকবার কয়েকটা পার্টিতে গেছে। কিন্তু সে সব পার্টি ছিল অন্য রকম। সব ব্যস্তসমস্ত মানুষ শেরোয়ানি পবে, স্যুট পরে ভিড় জমাতো। অদ্ভুত ব্যস্ততা, যেন তাড়া খেয়ে ফিরছে সবাই। আর শক্ত শক্ত কথার ছড়াছড়ি, মুখ কঠিন করে, কপালে ভাঁজ তুলে গম্ভীর সব আলোচনা। একটুও ভালো লাগত না জরিনার।