- বইয়ের নামঃ সীমানা ছাড়িয়ে
- লেখকের নামঃ সৈয়দ শামসুল হক
- প্রকাশনাঃ মাওলা ব্রাদার্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. মা মারা গেছেন যখন
০১.
মা মারা গেছেন যখন জরিনা মাত্র সাত। শিশু–মনে লেগে থাকা কবেকার কয়েকটা মাত্র ছবি, আর অ্যালবামে কয়েকটা ফটোগ্রাফ শুধু বেঁচে আছে। যখন তার তার বয়স বারো, তখন বাবা মাঝে মাঝে দেখাতেন সেই ছবিগুলো। বলতেন তার মায়ের কথা। বলতেন, যখন নতুন মা রোকসানা ঘরে থাকতো না, কিংবা কাছাকাছি। একটাতে এক মহিলা তার বাবার পাশে বসে আছেন। পাড় গার কাঠ চেঁছে রং মাখানো চ্যাপ্টা পুতুলের মতো। পেছনের পটভূমির সঙ্গে যেন সেই মহিলার কোনো দূরত্ব নেই। আরেকটা ছবিতে শুধু সেই মহিলা। লতার মতো লীলায়িত একটা ময়ূর পাড় ঘোমটা ঘিরে রেখেছে সেই কাঠ পুতুলের মুখ। কিন্তু ঠোঁট জোড়া ভারী, একটু কালো কালো ছবিতে কালো, আসলে হয়ত গোলাপি এখুনি হয়ত হাসবেন। তারপর অ্যালবামের আরো দুটো পাতা ওলটালে বড়ো ছবি। সেই মহিলা শাল গায়ে বসে আছেন ভারী কাজ করা উঁচু নকশাপিঠ চেয়ারে। পাশে দাঁড়িয়ে এগারো বছরের চালাক চালাক ছিপছিপে এক মেয়ে নূরুন্নাহার নতুন শাড়ি পড়েছে। এমন কি এও হতে পারে ওই ছবি তোলবার দিনই প্রথম সে শাড়ি পড়ল, তাই কেমন আড়ষ্ট। আর সেই মহিলার কোলে পাঁচ বছরের আরেকটি মেয়ে। হাঁ করে বোকার মতো তাকিয়ে আছে সমুখের দিকে। ঠোঁট ঝুলে পড়েছে। অপরূপ ভঙ্গিতে তাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে আছেন সেই মহিলা।
কিন্তু ছবিগুলো জরিনা আর কোনোদিন দেখতে চায়নি। এখন তো একেবারেই নয়। বরং সে মনে না করতে পারলেই বাঁচে। সে স্মৃতি শুধু থেমে থাক, দৃষ্টি করলে যার প্রতিক্রিয়া হয় না, সে স্মৃতি স্মৃতিই নয়। তার মনে যে মহিলা আছেন, সেই ভালো, যে মহিলা ঝুঁকে পড়ে তার পাঁচ বছরের কোকড়ানো কালো চুলে গাঢ় নীল রিবন বেঁধে দিচ্ছেন।
.
শাহ সাদেক আলী একবার হাসলেন রোকসানার দিকে তাকিয়ে। গলাটাকে যথাসম্ভব মোলায়েম করে বললেন, তোমার ওই দোষ। নিজের মতটাকে অন্যের ওপরে চাপিয়ে দিতে চাও। সে বেচারার যে কিছু বলার থাকতে পারে তোমার মনেই হয় না। রোকসানা বলেছিল, নতুন বাড়িতে দোরপর্দা হবে হালকা বাদামি রঙের। কিন্তু সাদেক বলেন, সবুজ। শুধু বলেই ক্ষান্ত হননি, গত পরশু সেই নির্দেশ দিয়ে এসেছেন ডেকোরেটর মোহাম্মদ সোলেমানকে। কিন্তু তাতেও দোষ হতো না, যদি পরশুদিনই তিনি কথাটা বলতেন রোকসানাকে। বলেছেন সবে আজ। রোকসানার রাগ এ কারণেই আরো কিছুটা উঁচু পর্দায়। আবার সে বললো, আপনি তাহলে–।
একটু চা দিও।
সাদেক আলী কলম তুলে প্যাডে লিখতে লিখতে বললেন। দশ বছরের বিবাহিত জীবনে রোকসানা এটুকু জেনেছে যে, এই কথার আড়ালে কী তিনি বলতে চান। তাই কথাটা দূরে দাঁড়ানো রোকসানার কানে গিয়ে বাজলো যেন থামো। তাকিয়ে রইলো সেই মানুষটার দিকে যে প্যাডে একটানা লিখে চলেছে দেশে খাদ্য সঙ্কটের ওপর বিবৃতি।
শাহ সাদেক আলী পছন্দ করেন না তার বিবৃতি লিখে দেবে কোনো মাইনে করা সেক্রেটারী অথবা তার পার্টির কোনো উমেদার, যারা অপেক্ষায় থাকে পার্টি কবে ক্ষমতায় আসবে, আর ক্ষমতায় এলেই যারা উঠে পড়ে লেগে যাবে, কীসে দুটো পয়সা করা যায়। এই সততাই সাদেককে অত্যন্ত সাধারণ স্তর থেকে তুলে এনেছে আজকের ঈর্ষাযোগ্য সামাজিক স্তরে, রাজনৈতিক খ্যাতির শিখরে। অবশ্য আজকের দিনে রাজনীতিতে খ্যাতি বলতে যা বোঝায় সে খ্যাতি কোনোদিনই তাঁর আসেনি, তিনিও চাননি।
জরিনার মা এসেছিলেন যখন, সাদেক তখনো ছাত্র। শ্বশুর পাঠালেন বিলেতে। বিলেত থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে দেশে ফিরে এলেন। প্রাকটিস শুরু করলেন কলকাতা হাইকোর্টে। সে কতকাল আগের কথা। তারপর সারা ব্রিটিশ বাংলায় জেগে উঠলো মুসলমান সমাজ। মুসলিম মধ্যবিত্তের যেন মেরুদণ্ড গড়ে উঠলো মাত্র কয়েক বৎসরে। মেরুদণ্ড পেলেন শাহ সাদেক আলী। এই সময়ে এক মামলার ব্যাপারে যেতে হয়েছিল বম্বে। আর এই যাত্রাই তার জীবনে এনে দিলো এক নতুন মোড়। বম্বেয় তার সঙ্গে দেখা হলো মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর।
কলকাতায় ফিরে এসে সাদেক যোগ দিলেন রাজনীতিতে। সেদিন থেকে শুরু করে আজ আটান্ন বছর বয়স অবধি রাজনীতি তাঁর সাধনা হয়ে আছে। এর পেছনে তার প্রথমা স্ত্রী জরিনার মায়ের দানও কম নয়। কিন্তু জরিনার মা থাকতেন সকলের, এমনকি সাদেকেরও অলক্ষ্যে। তাই কোনদিনই তিনি বুঝতে পারেননি যে একজোড়া শুভ্র চোখ তাকে সারাক্ষণ উজ্জ্বল করে রেখেছে।
একদিন বড় অন্ধকার ঠেকল, যেদিন জরিনার মা মারা গেলেন। সেদিন তাঁর একটি অঙ্গচ্ছেদ হয়ে গেল যেন। সেদিন তিনি বিশেষ করে বুঝতে পারলেন কতখানি অবলম্বন তিনি পেয়েছিলেন তাঁর এই রাজনৈতিক জীবনে জরিনার মায়ের কাছ থেকে। কাজ আর কাজ কাজের অবিরাম প্রবাহে হঠাৎ একটা বিষম ধাক্কা খেলেন সাদেক। কিন্তু সামলে নিতে জানেন তিনি। তাই ওপর থেকে কিছু বোঝা গেল না, সাদেক স্থিরতর হলেন, আরো নিমগ্ন–লক্ষ্য রইলো তেমনি অবিচল।
রোকসানা এসেছে তার জীবনে অনেক পরে, দীর্ঘ চার বৎসর একক জীবন যাপনের পরে। রোকসানা ইউনির্ভাসিটিতে পড়েছে। রোকসানা যে ধরনের মহিলা সেকালে তাকে বলা হতো স্বাধীন জেনানা। জরিনার মা পড়তে পারতেন কাগজের মোটা হেডিংগুলো আর লিখতেন একটা বানান তিনবার ভেবে। জরিশার মা সাদেকের সমুখেও ভালো করে ঘোমটা না টেনে স্বস্তি পেতেন না। একটা তুলনামূলক বিচারে এলে, শাহ সাদেক আলী অনেকদিন ভেবেছেন, জরিনার মা তার অন্তর্লীন একটি সত্ত্বা, আর রোকসানা তার শুধু স্ত্রী, দ্বিতীয় স্ত্রী। তাই রোকসানা যে মানুষকে পাবে বলে আশা করেছিল, সে মানুষকে কোনদিনই পায়নি। কিন্তু এ অভিযোগও সে কোনোদিন করতে পারবে না যে সাদেক তাকে ভালোবাসেননি। মনে আছে বিয়ের পরদিন রোকসানা স্বামীকে তুমি সম্বোধনে কথা বলেছিল। সাদেক তখনি কিছু বলেননি। বলেছেন খাবার টেবিলে। তুমি আমার স্ত্রী, তোমার আমার দূরত্ব থাকবে না। শুধু একটা তুমি দিয়ে যদি কাছাকাছি হতে পারি তাহলে মনে হয় বিশ্ব সংসারে অনেক সমস্যাই এরপরে আর থাকছে না।