মাথা নীচু করে কী যেন ভাবল বৈদ্যনাথ। তারপর থেমে থেমে আস্তে আস্তে বললে—‘কলকাতায় আমার আর এক মামা থাকেন। সওদাগরী আপিসে পঁচাত্তর টাকা মাইনের চাকরি করেন। তাছাড়া আরো দু-চারজন আত্মীয় যে কলকাতায় নেই তা নয়। কিন্তু কোনো আত্মীয়ের আশ্রয়ে আর আমি থাকতে চাই না বলেই তোমার কাছে এসেছি।’
ওর মনের মধ্যে নিরন্তর একটা জ্বালা তুষের আগুনের মতো জ্বলছে, আজ তা প্রকাশ হয়ে পড়ল। চাঁদপুরে মামার বাড়িতে ওর মায়ের গলগ্রহ হয়ে থাকার নির্যাতন ও মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারছে না। এর পরে আর কোনোদিন খাওয়া নিয়ে পীড়াপীড়ি করিনি। রাত্রে বাড়ি ফিরে কোনোদিন ও নিজেই মা’র কাছে চেয়ে খেত, কোনোদিন খেত না।
দু-চারদিন ঘোরাঘুরির পরেই বৈদ্যনাথের একটা চাকরি জুটে গেল। ধর্মতলা স্ট্রীটের এক ওষুধের ল্যাবরেটরিতে, মাইনে কুড়ি টাকা। কালীঘাট থেকে বোজ হেঁটে ধর্মতলায় যায়, রোজ হেঁটে আসে। মাস গেলে সম্পূর্ণ মাইনেটি সে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়। তার এই কঠোর পরিশ্রমের একমাত্র পরিতৃপ্তি সেইখানে।
একদিন কৌতূহলবশত আমি বললাম—‘আচ্ছা বৈদ্যনাথ, তুমি যে এতটা দীর্ঘ পথ হেঁটে যাও আর হেঁটে ফের, কোনোদিন ক্লান্তি বোধ হয় না?”
সে বললে—‘জানো বিশ্বনাথ, আমি স্বপ্ন দেখতে দেখতে চলি। পথ-ক্লেশ তাই আমি টের পাইনে।’
অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম—‘স্বপ্ন মানে?’
‘মানে অতি সরল। আমি কল্পনা করতে করতে পথ চলি কবে মামার মত পঁচাত্তর টাকা মাইনে আমার হবে।’
এত দুঃখকষ্ট আর বিপর্যয়ের মধ্যে দিন কাটিয়েও বৈদ্যনাথ তার মায়ের দুঃখ ঘোচাবার কঠিন সংকল্প থেকে একচুলও বিচ্যুত নয়।
একদিন সন্ধ্যায় বাড়ির রোয়াকে বসে আছি, দূর থেকে দেখতে পেলাম বৈদ্যনাথ আসছে, কিন্তু হাঁটছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। কাছে আসতেই বললাম—‘তুমি খুঁড়িয়ে হাঁটছো কেন? পায়ে কোনো চোট লেগেছে নাকি?’
‘এমন কিছু না। চটি জুতোর একটা পেরেক ক’দিন ধরে গোড়ালির তলায় খোঁচা দিচ্ছিল। ইট ঠুকে চালিয়ে নিচ্ছিলাম। আজ সকালে কাজে যাবার সময় অনেক ঠোকাঠুকি করেও পেরেকটাকে বাগ মানাতে পারিনি। থেকে থেকে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে।’
শংকিত হয়ে বললাম, ‘কাজটা ভালো করোনি বৈদ্যনাথ। একজোড়া চটি কিনে নিলেই তো পার। ওটা পুরনো হয়ে গেছে, মুচি দিয়ে মেরামত করেও কাজ চালাতে পারবে বলে মনে হয় না।
একটি দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বৈদ্যনাথ বললে—‘কালই কিনব মনে করেছি।’
রাত্রে কিছু না খেয়েই বৈদ্যনাথ শুয়ে পড়ল। একটা অসোয়াস্তিতে সারারাত ও ছটফট করেছে, ঘুমোতে পারেনি। তবু একবারও আমাদের ডেকে কিছুই বলেনি।
প্রতিদিন সকালে সবার আগেই বৈদ্যনাথ ঘুম থেকে ওঠে। ব্যতিক্রম ঘটল পরের দিন সকালে। টেবিলের তলায় কুঁকড়ে শুয়ে আছে বৈদ্যনাথ। কোনো হুঁশ নেই। গায়ে হাত দিয়ে দেখি প্রবল জ্বর, চোখ দুটো জবা ফুলের মতো লাল। বৈদ্যনাথ ঘোরের মধ্যে একবার শুধু বললে, পায়ে অসহ্য যন্ত্রণা।
ছুটে চলে গেলাম পাড়ার এক পরিচিত ডাক্তারের কাছে। বৈদ্যনাথকে পরীক্ষা করেই ডাক্তার বললেন—‘ওকে এখুনি হাসপাতালে নিয়ে যান, বাড়িতে রেখে এ-রোগের চিকিৎসা হবার উপায় নেই।’
বিস্মিত হয়ে বললাম—‘এমন কি হয়েছে যে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে?’
‘পায়ে পচন ধরেছে।’
ডাক্তারের কথা শুনে একটা আসন্ন বিপদের কালো ছায়া আমার চোখের উপর নেমে এল। আমি ঘাবড়ে গেলাম। সুদূর চাঁদপুরে এক নিঃসহায় বিধবা তার একমাত্র পুত্রকে আমাদের ভরসায় পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত আছেন। যদি কিছু অঘটন ঘটে যায় তাঁর কাছে কী জবাবদিহি দেব। আমার যা অবস্থা, তাতে বাড়িতে রেখে বড় ডাক্তার দেখিয়ে বৈদ্যনাথের চিকিৎসা করা একেবারেই অসম্ভব। পাড়ায় আমার এক বন্ধু আছে। নাম তার ভোলা। বিপদে আপদে পাড়ার প্রত্যেক বাসিন্দার সে একমাত্র বল-ভরসা।
বিপদের কথা শুনেই ভোলা বললে—‘ডাক্তার যখন বলেছে তখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াই উচিত।’
‘কিন্তু—’
‘এর মধ্যে আর ‘কিন্তু’ থাকতে পারে না। তুই তৈরী হয়ে নে। আমি এখুনি ট্যাক্সি নিয়ে আসছি।’
সেই মুহূর্তেই ভোলাকে সঙ্গে নিয়ে বৈদ্যনাথকে ধরাধরি করে ট্যাক্সিতে চাপিয়ে প্রথমেই নিয়ে গেলাম শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে। রুগী দেখেই হাসপাতালের ডাক্তার বললেন—‘গ্যাংগ্রিন হলে এখুনি সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে ভর্তি করে নিতাম। কিন্তু সন্দেহ হচ্ছে টিটেনাস ইনফেকশনও হয়েছে। এ-রোগের চিকিৎসা শম্ভুনাথে হবার উপায় নেই, ওকে ক্যাম্বেল কিংবা কার-মাইকেলে এখুনি নিয়ে যান।’
পাড়ার ডাক্তার শুধু নয়, হাসপাতালের হাউস ফিজিসিয়ান পর্যন্ত যখন এ-কথা বললেন তখন আর সন্দেহ রইল না যে বৈদ্যনাথকে নিয়ে এক চরম বিপর্যয়ের সম্মুখে আমরা উপস্থিত। দিশাহারা অবস্থায় আমি বেঞ্চির উপর বসে পড়েছি, কিছু ভাববার বা করবার মতো মনের জোর পর্যন্ত তখন আমার হারিয়েছে।
আমার অবস্থা দেখে ভোলা প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বললে—‘দেখ বিশে, এখানে বসে হা-হুতাশ করলেই কি বৈদ্যনাথ বাঁচবে? চল, আর এক মুহূর্ত দেরী করা চলবে না। উঠে পড়।’
বৈদ্যনাথকে আবার ধরাধরি করে ট্যাক্সিতে তোলা হল। এখন আমাদের গন্তব্যস্থল কোথায়? ক্যাম্বেল না কারমাইকেল! ক্যাম্বেল যখন কাছে পড়ছে তখন সেখানে যাওয়াই আমি স্থির করলাম।