ওর ছেলেমানুষী নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে দুজনে স্টমারঘাটায় যখন এসে পৌঁছলাম তখন বিকেল হয়েছে। মেঘনা নদীর কূল দেখা যায় না, সমুদ্রের মতই বিশাল। দূরে মাঝনদীতে স্টীমার চলে যাচ্ছে, বৈদ্যনাথ সেই দিকেই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
মেঘনা নদীর বুকে সোনার আলো ছড়িয়ে সূর্য অস্ত যেতেই আমরা উঠে পড়লাম। ফেরার পথেও বৈদ্যনাথ কলকাতা সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন করল, জানবার কৌতূহল তার অসীম। বৈদ্যনাথের সঙ্গে সেদিন আমার প্রথম পরিচয়, সে-পরিচয় অচিরে গভীর বন্ধুত্বে পরিণত হল। সেদিন থেকে বৈদ্যনাথই ছিল আমার নিত্যসঙ্গী।
মাস দুই পর চাঁদপুরে আদায়পত্তরের কাজ শেষ করে বাবা চলে এলেন নিজেদের গ্রামে। বিদায় দেবার জন্যে স্টমারঘাট পর্যন্ত এসেছিল বৈদ্যনাথ। যতক্ষণ স্টীমার দেখা যায় সে জেটী থেকে এক পাও নড়েনি।
॥ তিন ॥
চাঁদপুর থেকে চলে আসার পর বৈদ্যনাথের সঙ্গে দীর্ঘকাল আর আমার কোনো যোগাযোগ ছিল না। গ্রামের ইস্কুল থেকে ম্যাটিক পাস করে কলকাতায় এসে কলেজে ভর্তি হয়েছি। বাবা তখন থাকতেন কালীঘাটে, একখানি মাত্র ঘর। মা, আমরা দুই ভাই আর এক বোন—এই নিয়ে আমাদের সংসার। বাবার সামান্য রোজগার, সেই রোজগারের সন্ধানে বছরের বেশিভাগ সময় বাইরে বাইরেই তাঁকে কাটাতে হয়।
দীর্ঘকালের অদর্শনে আমার কৈশোরকালের ক্ষণিকের বন্ধু বৈদ্যনাথের কথা মন থেকে প্রায় মুছে গিয়েছিল। হঠাৎ মা’র কাছে চাঁদপুরের পিসিমার এক চিঠি এসে হাজির। পিসিমা জানিয়েছেন, অর্থের অভাবে বৈদ্যনাথ ম্যাট্রিক পাস করে ঘরে বসে আছে, কুমিল্লায় কলেজে পড়াবার মতো অবস্থা ওর মায়ের নয়। ভাইয়ের বাড়িতে গলগ্রহ হয়ে আছে, তাতে লাঞ্ছনার শেষ নেই। বৈদ্যনাথ কলকাতায় এসে যে-কোনো উপায়ে একটা চাকরি খুঁজে নিতে চায়। পিসিমা তাই অনুরোধ জানিয়েছেন, যতদিন না একটা কাজ জুটিয়ে নিতে পারছে ততদিন কলকাতায় আমাদের বাসায় একটু মাথা গুজবার জায়গা যেন ওকে দিই।
পিসিমার চিঠি পড়ে কিশোর বালক বৈদ্যনাথের ছবি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। দারিদ্র্য, লাঞ্ছনা ও শত অপমানের মধ্যেও তার তেজোদ্দীপ্ত রূপটি ভোলার নয়। একগুয়ে ও অভিমানী সে ছিল, কিন্তু আত্মমর্যাদাবোধ ছিল তার অপরিসীম।
বৈদ্যনাথের সঙ্গে আবার দেবা হবে এই আশায় মা’র হয়ে আমিই চিঠি লিখে দিলাম পিসিমাকে। জানিয়ে দিলাম, বৈদ্যনাথকে অবিলম্বে কলকাতায় আমাদের বাড়ি পাঠিয়ে দিতে। মা শুধু একবার চিন্তিত হয়ে বলেছিলেন—‘একখানা মাত্র ঘর, তার উপর তোরা এতজন। থাকার জায়গা কি করে হবে রে?’
আমি বললাম—‘তার জন্যে ভেবো না মা। খুব অসুবিধা হলে অন্য ব্যবস্থা করা যাবে। এখন তো চলে আসুক।’
চিঠি পাঠাবার দিন সাত পরেই এক সন্ধ্যায় বৈদ্যনাথ এসে হাজির। চেহারা বদলে গেছে। কিশোর বালক এখন তরুণ যুবা। চোখ দুটি আরো শান্ত কিন্তু আরো উজ্জ্বল। এত দুঃখকষ্টের মধ্যেও মুখের দীপ্তি কিছুমাত্র কমেনি। একটা ছোট্টো টিনের তোরঙ্গ, দু-এক জোড়া জামাকাপড় শুধু আছে। বিছানাপত্র কিছুই নেই। আমাদের একটিমাত্র ঘর এবং এতজন মানুষ দেখে বৈদ্যনাথ আগেই স্থির করে নিয়েছিল যে ঘরের কোণায় টেবিলটার তলায় খবরের কাগজ পেতেই ও শোবে, বিছানার কোনো প্রয়োজন নেই। ও একবার যা স্থির করেছে তা থেকে এক চুল নড়ানো কারো সাধ্যি নেই, আমি তা জানতাম। অনেক সাধ্য-সাধনার পর মা শুধু ওকে একটা ছোটো মাথার বালিশ ব্যবহার করতে রাজী করাতে পেরেছিলেন, তার বেশি আর কিছুই নয়।
পরদিন সকাল থেকেই শুরু হয়ে গেল বৈদ্যনাথের প্রাণপাত পরিশ্রম চাকরির সন্ধানে। সকালে বেলা আটটার মধ্যেই দুটি ডাল-ভাত কোনো-রকমে মুখে দিয়েই ও বেরিয়ে পড়ে, ফেরে সন্ধ্যার পর। সম্ভব-অসম্ভব নানা জায়গায় ঘোরাঘুরির পর এক দোকানে খাতা লেখার কাজ পেল, পনেরো টাকা মাইনে। তিন মাস কাজ করার পর দশটা টাকা ছুঁইয়ে দোকানের মালিক বললে, বাজার খুবই মন্দা। আপাতত এর বেশি আর কিছুই দিতে পারছে না। রাগ করে কাজ ছেড়ে দিল বৈদ্যনাথ। কিন্তু টাকাটা সে তার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিল, প্রথম রোজগারের টাকা। আমার কাছ থেকে নানা আপিসের ঠিকানা সংগ্রহ করে আবার শুরু হল তার পথপরিক্রমা। সেই সকালে বেরিয়ে যায়, রাত্রে ফেরে। অধিকাংশ দিনই রাত্রে সে বাড়িতে খেত না, বলত বাইরেই খেয়ে নিয়েছে। আমি ভালভাবেই জানতাম বৈদ্যনাথ একবেলা অনাহারেই থাকত। ততদিনে ওর চরিত্র আমার জানা হয়ে গিয়েছে। এ-সম্বন্ধে কিছু বলতে গেলে হয়ত ও আমার বাড়ি ছেড়ে ট্রাম ডিপোর গুমটিতে গিয়ে আশ্রয় নেবে। তবু একদিন না বলে পারিনি, মা’র পীড়াপীড়িতেই বলতে হল।
সেদিন রাত্রে শ্রান্ত ক্লান্ত বৈদ্যনাথ বাড়ি ফিরেই মুখহাত ধুয়ে টেবিলের তলায় শুতে যাবে, আমি বাধা দিলাম।
‘বৈদ্যনাথ, বেশ বুঝতে পারছি তোমার রাত্রে কিছু খাওয়া হয়নি। আমাদের সঙ্গে খাবে চলো। না খেলে আমরাও কেউ খাব না।’
বৈদ্যনাথ স্তব্ধ হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল। চোখের দীপ্তি আরো প্রখর, আরো তীব্র। ও যে প্রচণ্ড বদরাগী আর একগুঁয়ে আমি তা জানতাম। ওর দারিদ্র্যের প্রতি কেউ যদি ইঙ্গিত করে বা ওর আত্মমর্যাদায় যদি কেউ ঘা দেয় কখনও সে তা সহ্য করবে না। ওর চোখমুখের ভাব দেখে মনে হল বোধহয় সে এই মুহূর্তেই আমাদের ঘর ছেড়ে চলে যাবে। ও কিছু বলবার বা করবার আগেই ওকে শান্ত করবার জন্যে বললাম—‘সারাদিন তুমি এতো ঘোরাঘুরি করো, পরিশ্রম করে, তাতে তোমার শরীর ভেঙ্গে পড়ছে তা কি তুমি বোঝো না? তার উপর যদি এই ভাবে একবেলা না খেয়ে কাটাও একটা শক্ত অসুখে পড়তে কতক্ষণ! আমি তোমার স্বাস্থ্যের অবস্থা দেখেই কথাটা বলেছি, আর কিছুর জন্যে নয়।’