আপিস যাওয়া হল না। বিশুদাকে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।
সারা পথ বিশুদা নীরব, একটি কথাও বললেন না। বসবার ঘরে ঢুকেই তাকিয়াটা মাথায় দিয়ে খাটের উপর ধপাস করে শুয়ে পড়লেন। চোখ দুটি বন্ধ, মুখে কোনো কথা নেই।
বিশুদ। হঠাৎ শোকে এতটা মুহ্যমান হয়ে পড়বেন আমি তা ভাবতেও পারিনি। ব্যাঙ্কে সামান্য বেতনে কেরানীর চাকরি করেন বিশুদা, বৃহৎ সংসার নিয়ে দারিদ্র্যের সঙ্গে তাঁর নিত্য সংগ্রাম। তবু বিশুদার বিষণ্ণ মুখ কোনোদিন আমি দেখিনি।
বিশুদা তখনো চোখ বুজে চুপচাপ শুয়ে আছেন । এই অসহনীয় নীরবতা থেকে মুক্তি পাবার জন্যে আমি বললাম, ‘বিশুদা, এক কাপ চা খাবেন?’
বিশুদা এবার চোখ খুললেন। খাটের উপর উঠে বসে বললেন—‘না, চা খাবো না। এক গেলাস জল দিন।’
এক গেলাস জল এনে দিতেই নিমেষে তা নিঃশেষ করে বললেন— ‘আরেক গেলাস দিন, বড় তেষ্টা পেয়েছিল।’
আরেক গেলাস জল খেয়ে বিশুদা এবার ধাতস্থ হলেন। তাকিয়াটার উপর ক্লান্ত দেহটাকে এলিয়ে দিয়ে বললেন—‘টালিগঞ্জে গিয়েছিলাম বৈদ্য-নাথের সঙ্গে দেখা করতে দেখা পেলাম না। কাল দুপুর থেকেই সে ডাঃ রায়ের বাড়িতে পড়ে ছিল, রাত্রেও বাড়ি ফেরেনি, এখনও না। বোধহয় প্রসেশনের সঙ্গেই ও আছে।’
কে এই বৈদ্যনাথ! এর কথা বিশুদার মুখে কোনোদিন শুনিনি। তাছাড়া আজকের দিনের ঘটনার সঙ্গে বৈদ্যনাথের সম্পর্কই বা কি! আমার চিন্তার জাল ছিন্ন করে বিশুদ। আবার বললেন—‘বৈদ্যনাথের ছেলেমেয়ে তিনটে আমাকে দেখেই কেঁদে আকুল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর বলছে— কাকাবাবু, আমাদের আপনি নিয়ে চলুন, দাদুকে শেষবারের মতো একবার দেখব।’
আমার মুখে কোনো প্রশ্ন নেই, বৈদ্যনাথ সম্পর্কে অপার বিস্ময় নিয়ে বসে আছি।
দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বিশুদা বললেন—‘বৈদ্যনাথের মা কাল থেকে জল পর্যন্ত মুখে দেননি, কেঁদে কেঁদে শয্যা নিয়েছেন। ওর স্ত্রী পাথরের মতো ঘরের এক কোণায় স্তব্ধ হয়ে বসে ছিল, আমাকে দেখেই পাগলের মতো চীৎকার করে কান্না! কোথায় গেলাম বৈদ্যনাথকে একটু সান্ত্বনা দিয়ে আসব, কিন্তু কী পরিস্থিতির মধ্যেই গিয়ে পড়লাম বলুন তো।’
বৈদ্যনাথ ও তার পরিবার আমার কাছে বিরাট রহস্য হয়ে দেখা দিল। কৌতূহল আর চেপে রাখতে না পেরে বৈদ্যনাথের পরিচয় জানবার জন্যে উৎসুক হয়ে বিশুদাকে প্রশ্ন করতে যে কাহিনী সেদিন বিশুদা আমাকে শুনিয়েছিলেন তা যেমন বিস্ময়কর তেমনি মর্মস্পর্শী। বিশুদার জবানীতেই সে-কাহিনী আপনাদের কাছে উপস্থিত করলাম।
॥ দুই ॥
ছেলেবেলায় বেশ কিছুকাল আমাকে পূর্ববঙ্গে চাঁদপুর শহরে কাটাতে হয়েছিল। কাজের উপলক্ষে বাবাকে প্রায়ই চাঁদপুর যেতে হত, মাঝে মাঝে আমিও যেতাম। চাঁদপুরে পুরান বাজারে আমার এক দূর সম্পর্কের পিসি থাকতেন, তাঁর কাছে আমাকে রেখে বাবা বেরিয়ে পড়তেন গ্রাম থেকে গ্রামে আদায়পত্তরের কাজে। ওখানে সঙ্গী সাথী বড় একটা কেউ আমার ছিল না। আমি পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার গ্রামের ছেলে, তাই স্বাভাবিক সংকোচবশতই সমবয়সী ছেলেদের সঙ্গ এড়িয়ে চলতাম। যে পাড়ায় থাকতাম সেই পাড়ারই কয়েকটা বাড়ির পরে থাকত বৈদ্যনাথ। মায়ের একমাত্র সন্তান, সে-ও আমারই মতো নিঃসঙ্গ। তার একটা কারণও ছিল। বৈদ্যনাথের জন্মের পর ওর বাবা স্ত্রী-পুত্র পরিত্যাগ করে নিরুদ্দেশ হয়। নিঃসহায় নিঃসম্বল মা একমাত্র পুত্র বৈদ্যনাথকে বুকে করে আশ্রয় নিলেন ভাইয়ের বাড়িতে। উদয়াস্ত পরিশ্রম, তবু লাঞ্ছনার শেষ নেই। জ্ঞান হওয়া অবধি মায়ের নীরব চোখের জল শুধু দেখেছে বৈদ্যনাথ কিন্তু কারোর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করতে কখনো শোনেনি।
বৈদ্যনাথ ইস্কুলে যেত আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে। গায়ে তালি দেওয়া ইজের-কামিজ, কিন্তু তার জন্য কোনো সংকোচ ওর ছিল না। তেজী ও তাজা ঘোড়ার বাচ্চার মতন ছুটতে ছুটতে ও স্কুলে যেত, আবার ছুটতে ছুটতেই ফিরত।
এক শনিবার দুপুরে স্কুল থেকে ফিরছে, রাস্তায় ওকে ধরলাম।
‘ভাই, চাঁদপুর স্টীমারঘাটে আমার বড় বেড়াতে যাবার ইচ্ছে কিন্তু পিসিমা আমাকে একা যেতে দিতে চান না। তুমি আমাকে নিয়ে যাবে?’
আমার অনুরোধ তাকে বেশ কিছুটা অবাক করে দিল। আমাকে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করে বললে—‘তুমি কলকাতা থেকে এসেছ?’
‘না, ঠিক কলকাতা নয়, এসেছি বর্ধমান থেকে। তবে কলকাতা হয়ে যাওয়া-আসা করতে হয়।’
রাজী হয়ে গেল বৈদ্যনাথ। বললে, ‘আমি একবার মাকে বলে এক্ষুনি আসছি।’।
ছুটে চলে গেল বৈদ্যনাথ। পিসিমাকে কথাটা বলতেই খুশি হয়ে বললেন—‘বৈদ্যনাথ বড় ভাল ছেলে। ওর মায়ের দুঃখের শেষ নেই, কিন্তু এই ছেলের মুখ চেয়ে নীরবে সব সহ্য করছে।’
কিছুক্ষণ পরেই বৈদ্যনাথ এল। পিসিমা সস্নেহে মুড়ি-নারকোল খেতে দিলেন, বৈদ্যনাথ কিছুতেই খাবে না। অনেক সাধ্যসাধনার পর দুজনে একসঙ্গে খেলাম, কিন্তু এটা ওর মনঃপূত নয় তা বুঝতে বিলম্ব হয়নি।
রাস্তায় চলতে চলতে কলকাতা সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন করে গেল বৈদ্যনাথ। ওর ছোটো মামা কলকাতায়। পুজোর ছুটিতে যখন বাড়ি আসে তখন তার কথাবার্তা, চালচলন, সাজপোশাক দেখে বৈদ্যনাথ ধারণা করে নিয়েছে যে কলকাতায় গেলেই অনেক টাকা রোজগার করা যায়, বড়লোক হওয়া যায়, আর বড়লোক হতে পারলে বাড়িতে আদর যত্ন খাতির সম্মান তার বেশি।