ক’দিন পরেই অধ্যক্ষের নতুন চিঠি। তিনি জানতে চেয়েছেন বিধানচন্দ্র বেলা চারটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত অন্য একটা ক্লাসের দায়িত্ব নিতে পারেন কিনা। ডাঃ রায় চিঠিটা পড়লেন, তারপর নিঃশব্দে সেটি ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। মাসখানেক পরে ফিজিওলজির ক্লাসে হঠাৎ মেজর রাইট উপস্থিত।—‘তুমি তো এখনও আমার চিঠির উত্তর দিলে না?’
‘আপনার চিঠি!’ বিধানচন্দ্র গম্ভীর ভাবে উত্তর দিলেন—‘সে তো সেদিনই ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি।’
‘মানে!’ গর্জন করে উঠলেন মেজর রাইট।
‘মানে অতি স্পষ্ট। সরকারী কাজ যখন, তখন তা আমি আক্ষরিক অর্থেই করতে চাই। চাকরি আমার তিনটায় শেষ, নয় কি?’
মেজর রাইট ঢোঁক গিললেন। কোন্ কথার জবাবে এই উত্তর, মেজর রাইটের তা বুঝতে বিলম্ব হল না।
এই মেজর রাইটের সঙ্গে ক্যাম্বেলেই আরেকটি ঘটনা। বাংলার গভর্নর ফ্রেজার সাহেব আসবেন হাসপাতাল পরিদর্শন করতে। মেজর রাইট হাস-পাতালের অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মীদের নিয়ে সেজেগুজে গেট্-এ দাঁড়িয়ে আছেন গভর্নরকে অভ্যর্থনা করবার জন্যে।
এমন সময় গাড়ি হাঁকিয়ে বিধানচন্দ্র সেখানে এসে হাজির। গাড়ি থেকে নেমে কোনো দিকে ভ্রূক্ষেপ না করেই তিনি সোজা গিয়ে তাঁর বন্ধুর দলে মিশে গেলেন। কিন্তু মেজর রাইট-এর ধারণা ডাঃ রায় তাঁকে ইচ্ছে করেই অবজ্ঞা করেছেন।
হাসপাতাল পরিদর্শন হল, লাটসাহেব বিদায় নিলেন। পরমুহূর্তেই ডাক পড়ল বিধানচন্দ্রের। ক্ষিপ্ত হয়ে মেজর রাইট বললেন—‘তুমি যে তখন আমাকে দেখে টুপি খুললে না?’
বিনীত কণ্ঠে বিধানচন্দ্র বললেন—‘আমি আপনাকে লক্ষ করিনি স্যার! লক্ষ করলেও টুপি খুলতাম না, শুধু বলতাম ‘গুড মরনিং’। কেননা ইংলণ্ডের আদব-কায়দায় এইটিই রীতি, নিজের চোখে দেখে এসেছি।’
উত্তপ্ত কণ্ঠে মেজর রাইট বললেন—সেটা ইংলণ্ডের কথা, এটা ইণ্ডিয়া নয় কি?’
বিধানচন্দ্র উত্তর দিলেন—‘বেশ, আপনি সেই মর্মেই একটা লিখিত আদেশ জারী করুন, এবার থেকে টুপি খুলেই আপনাকে অভিবাদন জানাব।’
বলা বাহুল্য, রাইট এ প্রস্তাবে রাজী হননি। তিনি বুঝেছিলেন যে এই নেটিভ ডাক্তারের মতলব হচ্ছে ওকে আরও হাস্যকর করে তোলা।
আর একবার মেজর রাইট লক্ষ করলেন যে ছাত্ররা তাঁকে দেখে শুধু ‘গুড মরনিং’ বলে দিব্যি পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে, কেউ ছাতা বন্ধ করছে না। অথচ ক্যাম্বেলে তখন কড়া নিয়ম ছিল সামনে কোনো অধ্যাপক এলে তাঁকে সম্মান দেখাবার জন্য ছাতা বন্ধ করতেই হবে, কিন্তু বিস্মিত হয়ে তিনি কিছুদিন ধরে লক্ষ করছেন যে তাঁকে দেখে তো নয়ই, কোনো অধ্যাপককে সামনে দেখে ছাত্ররা ছাতা বন্ধ করছে না।
ছাত্রদের ডাক পড়ল অধ্যক্ষের আপিস-ঘরে। হম্বিতম্বি করার পরই জানা গেল এই বিদ্রোহের নায়ক বিধানচন্দ্র। বিধানচন্দ্রকে ডেকে পাঠিয়ে মেজর রাইট জানতে চাইলেন যে, অধ্যাপক হয়ে ডিসিপ্লিন না মানবার জন্যে ছাত্রদের উস্কানি দেবার অর্থ কি।
উত্তরে বিধানচন্দ্র মেজর রাইটকে জানিয়ে দিলেন যে, ওটাকে ডিসিপ্লিন বলে না, ওটা একটা বিরক্তিকর প্রথা।
মেজর রাইট আর কথা বাড়ালেন না, অপমানটা হজম করেই গেলেন। এতদিনে তিনি বিধানচরিত্রের খানিকটা আঁচ পেয়ে গিয়েছিলেন, বুঝেছিলেন, এ মেরুদণ্ডকে নত করা ওঁর সাধ্য নয়।
ইংরেজ চরিত্রের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, পরাজিত হলেও বিপক্ষের মহত্ত্বকে স্বীকৃতি জানাতে সে কার্পণ্য করে না। মেজর রাইটও তাই করেছিলেন। অবসর নেবার সময় হবার বেশ কয়েক বছর আগেই তিনি চাকুরিতে ইস্তফা দিলেন। শুধু তাই নয়, যাবার আগে ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়কে ডেকে পাঠিয়ে সস্নেহে হ্যান্ডশেক্ করে বলেছিলেন—
‘আমি অসময়ে কেন অবসর নিচ্ছি জান? আমি জানি এই প্রতিষ্ঠানে আমার চেয়ে বহুগুণ বেশি যোগ্য শিক্ষক থাকতে আমার পক্ষে এ-কাজ করা অনুচিত।’
সহসা আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে রব উঠল—‘ওই আসছেন, ওই এসে গেছেন।’
মুহূর্তের মধ্যে ছড়ানো ছিটানো বিক্ষিপ্ত জনতা চৌমাথার উপর মৌচাকের মতো জমাট বেঁধে গেল। আমি তখনো সাদার্ন অ্যাভিনিউর মোড়ের মেহগনি গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে বিস্মিত হয়ে ভাবছিলাম যে খাঁটি মানুষকে চিনতে জনতা ভুল করেনি। নইলে, বেশ-ভূষা আচারে ব্যবহারে যিনি একান্ত সহজ সরল অনাড়ম্বর ছিলেন, রাজনীতির প্রকাশ্য-মঞ্চে সস্তা হাততালি কুড়োবার কোনো ভূমিকা যিনি কখনো নেননি, দেশ-মাতৃকার সেই নীরব সাধকের প্রতি অলক্ষে সঞ্চিত এত শ্রদ্ধা প্রীতি অনুরাগ সহসা স্বতোৎসারিত প্রস্রবণের মতো উদ্বেল হয়ে উঠল কী করে!
হঠাৎ দেখি আমার সামনে বিশুদা দাঁড়িয়ে। আমাদের পত্রিকা আপিসের শনিবারের আডডার সেই বিখ্যাত না-লিখে-সাহিত্যিক বিশুদা। চেহারা দেখে প্রথমে আমি চিনতেই পারিনি। অবিন্যস্ত চুল, গালভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি, গরমে ঘামে গায়ের গেরুয়া পাঞ্জাবি ভিজে শপ শপ করছে, মুখে থমথমে গাম্ভীর্য। বিশুদার এ চেহারা আমি কোনোদিন দেখিনি।
বিশুল্কমুখ বিশুদা আমাকে গম্ভীর হয়ে বললেন—‘চলুন আপনার বাড়ি। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই, কিছুই দেখতে পাবেন না’।
বিস্মিত হয়ে বললাম—‘কিন্তু আপনি এখানে? আর এ কী চেহারা হয়েছে আপনার—’
আরো গম্ভীর গলায় বিশুদা বললেন—‘সব বলছি, আগে চলুন আপনার বাড়ি।’