‘অর্থাৎ মাসে বারো টাকা? এমন দিনও হতে পারে আপনি একবারের ভিজিট বাবদই আমাকে দেড়শ টাকা দিচ্ছেন।’ হাসতে হাসতে কথাগুলি ছুঁড়ে মারলেন সেই গর্বান্ধ ধনীর মুখে।
রাগে গজরাতে লাগলেন তিনি, মুখ দিয়ে আর কথা বেরলো না। কাঁপতে কাঁপতে গাড়িতে উঠে বসলেন।
এই ঘটনার কয়েকমাস পরেই হঠাৎ কাছাকাছি একটি বাড়ি থেকে ‘কল’ এল। এক ধনীর মেয়ে আফিম খেয়েছেন। বেলা তখন পাঁচটা। বিধানচন্দ্র তখনি ছুটলেন। পরদিন সকালে আবার তিনি রোগী দেখলেন। মেয়েটি তাঁরই চিকিৎসার গুণে সেরে উঠেছেন। কৃতজ্ঞতায় ধনী পিতার চোখে জল।
‘কত ফী দেব ডাক্তার আপনাকে?’
বিধানচন্দ্র এক মুহূর্ত ভাবলেন। তারপর বললেন—‘এই বিশেষ কেসটিতে দেড়শ টাকা পেলেই আমি খুশি।’
তক্ষুনি চেক লেখা হয়ে গেল। চেকটি হাতে নেবার সময় ভদ্রলোকের চোখের দিকে তাকিয়ে বিধানচন্দ্র বললেন—‘মনে পড়ছে আমাকে? আমি সেই ডাক্তার যাকে আপনি বছরে দেড়শ টাকায় পুষতে চেয়েছিলেন।’
ডাঃ রায়ের চরিত্রের বজ্রকঠোর দিকটির পরিচয় এখানে দেওয়া হল, কিন্তু অপর দিকটি ছিল কুসুম-কোমল।
যাঁরা পয়সা দিতে পারতেন না, বিধানচন্দ্র তাঁদের কাছে কোনোদিনও পয়সা নেননি। কিন্তু যাঁদের দেবার ক্ষমতা আছে অথচ ভিজিট দিতে কার্পণ্য দেখান, তাঁদের বলতেন—‘চেম্বারে গিয়ে দিয়ে আসুন, সেখানে আমার ‘পুওর-বক্স’ আছে।’
ভিড়ের চাপে আর এক পাও এগোনো সম্ভব নয়। রাসবিহারী আর আশুতোষ মুখার্জি রোডের মোড়ে কাতারে কাতারে লোক। ট্রামগাড়ি-গুলি দাঁড়িয়ে, তার ভিতরে আর ছাতে লোকে লোকারণ্য। মধ্য দিনের প্রচণ্ড রোদ মাথায় নিয়ে অধীর প্রতীক্ষায় তারা দাঁড়িয়ে আছে, জনতার মধ্য থেকে আকুল আবেদন উঠছে—‘জল ঢালুন, জল ঢালুন।’ রাস্তার দুই পাশে বাড়ির ছাতে কার্নিশে বারান্দায় সমবেত মানুষদের কাছেই তাদের আবেদন। যে পারছে উপর থেকে বালতি বালতি জল ঢালছে রাস্তায় ফুটপাথে জমাট বাঁধা মানুষদের উপর।
আমি বিস্মিত হয়ে আবার ভাবছিলাম এই মানুষটির প্রতি জনতার এত শ্রদ্ধা ও ভালবাসার উৎসটি এতকাল কোথায় লুকিয়ে ছিল, আজ বাঁধভাঙ্গা বন্যার মতো উত্তাল হয়ে যা ছড়িয়ে পড়ল মহানগরীর রাস্তায় রাস্তায়!
মনে পড়ে গেল বিধানচন্দ্র রায়ের জীবনের আরেকটি ঘটনা। বিলেত থেকে ফেরার পর বিধানচন্দ্ৰ ক্যাম্বেল মেডিকেল স্কুলে শিক্ষক নিযুক্ত হয়েছেন। ইংলণ্ডের সর্বোচ্চ ডিগ্রীর অধিকারী হলেও মাইনে তাঁর সব মিলিয়ে মাসে তিনশ তিরিশ টাকা। তা হোক। সরকারী হাসপাতালে কাজ, অভিজ্ঞতাটা কাজে লাগবে। বিধানচন্দ্রের চরিত্রের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, যে-কাজে হাত দিতেন তাতেই সম্পূর্ণ ডুবে থাকতেন তিনি। এ-ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না।
কিছুদিন পরেই হঠাৎ ক্যাম্বেলের অধ্যক্ষ হয়ে এলেন ভারতীয় মেডিকেল সার্ভিসের সদস্য জনৈক মেজর রাইট। ক’দিন যেতে না যেতেই বিধানচন্দ্রের ডাক পড়ল তাঁর ঘরে। সাহেব বললেন—‘কি কাজ করো তুমি এখানে?’
বিধানচন্দ্র তাঁর কাজের ফিরিস্তি দিলেন।
মেজর রাইট বলে উঠলেন—‘আমার মনে হয় কাজের তুলনায় তুমি মাইনে একটু বেশী পাচ্ছ। নয় কি?’
‘তা বটে।’ উত্তর দিলেন বিধানচন্দ্র। ‘একজন এম আর সি পি (লণ্ডন), এফ আর সি এস (ইংলণ্ড) এবং কলকাতার এম ডি বেতন পাচ্ছেন মাসে তিনশ তিরিশ টাকা। কিন্তু অন্যজন এডিনবরার ফেলোশিপ ফেল করে পাচ্ছেন মাসে দেড় হাজার টাকা। সুতরাং প্রথম জনকে কিছু বেশিই দেওয়া হচ্ছে বইকি।’
মেজর রাইট সেই তীক্ষ্ম ব্যঙ্গোক্তির আর কোনো জবাব খুজে পেলেন না। কারণ তিনি দেড় হাজার টাকার মাইনে পেলেও ফেলোশিপ ফেল করা ডাক্তার।’
ইংবেজের পদানত ভারতবাসীর সেদিন গ্লানির শেষ ছিল না। কিন্তু ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া। পরাধীন দেশের মানুষ হলেও আত্মমর্যাদাবোধ ছিল তাঁর অপরিসীম। তাঁর ঐ এক সংকল্প ছিল— ‘হতে পারি দীন তবু নহি মোরা হীন’। সাদা চামড়ার কাছে তাই কোনোদিন তিনি নতি স্বীকার করেননি, যতই দোর্দণ্ড প্রতাপ তার থাকুক। মেরুদণ্ড সোজা রেখেই তিনি আজীবন সমানে টক্কর দিয়ে এসেছেন তাদের সঙ্গে।
এই মেজর রাইট প্রসঙ্গেই আরেকটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। প্রথম পরিচয়ের দিন থেকেই তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে আছেন বিধানচন্দ্রের উপর। ফলে ক’দিনের মধ্যেই অধ্যক্ষ রাইটের কাছ থেকে নির্দেশ এল বিধানচন্দ্রের কাছে যে, ক্যাম্বেলের ফিজিওলজি বিষয়ের শিক্ষককে বেলা বারোটা থেকে তিনটে পর্যন্ত নিজের বিভাগে উপস্থিত থাকতে হবে। কেননা তাই নিয়ম। নতুন নির্দেশের সমর্থনে মেজর রাইট পঞ্চাশ বছর আগেকার একটি নোটি-ফিকেশনের অংশ-বিশেষ উদ্ধৃত করেছেন।
চিঠিটা হাতে নিয়েই বিধানচন্দ্র অধ্যক্ষের ঘরে ঢুকলেন—‘এ নির্দেশ কি আক্ষরিক অর্থেই পালন করতে হবে আমাকে?’
‘হ্যাঁ।’ মেজর রাইটের কণ্ঠে বজ্রনির্ঘোষ।
বিধানচন্দ্র বললেন—‘না, অন্য রকমও হয় কি না, তাই বলছিলাম। আমরা যখন তৃতীয় শ্রেণীর ঠিকে গাড়ি ভাড়া করি তখন ভাড়া দিই ঘণ্টা হিসাবে, কিন্তু ট্যাকসির বেলা দিতে হয় দূরত্ব হিসাবে।’
মেজর রাইট ক্ষিপ্তকণ্ঠে বললেন—‘না, এক্ষেত্রে নির্দেশটা আক্ষরিক অর্থেই নিতে হবে।’
‘আচ্ছা স্যার।’ বিধানচন্দ্র তখনকার মতো বিদায় নিলেন।