প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি যে এই ঘটনার পরেও পুরোদস্তুর সাহেব হবার বাসনায় বিধানচন্দ্র নিজেই নিজের নাম নিয়েছিলেন—‘বেঞ্জামিন চার্লস রয়।’
কিন্তু বেঞ্জামিন চার্লস রয় থেকে বিধানচন্দ্র রায়ে ফিরে আসার ঘটনাটি আরো চমকপ্রদ। এম. বি. পরীক্ষার মাত্র দিন পনেরো বাকি। সকালে মেডিকেল কলেজের গেট-এ দাঁড়িয়ে আছেন বিধানচন্দ্র। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তিনি দেখছেন ধাত্রীবিদ্যার অধ্যাপক কর্নেল পেক্-এর ব্রুহাম গাড়িটা কলেজের দিকে আসছে। বেশ আসছিল, কিন্তু আচমকা মোড় ঘোড়াতে গিয়ে কোচম্যান বিপত্তি ঘটাল। তখন সবে ঘোড়ার বদলে বৈদ্যুতিক ট্রাম চালু হয়েছে। কর্নেল পেক্-এর গাড়ি ধাক্কা খেয়ে ভেঙে-চুরে একাকার হয়ে গেল। সৌভাগ্যবশত কর্নেল ও কোচম্যান দুজনেই অক্ষত অবস্থায় বেঁচে গেলেন। গাড়ি থেকে নেমেই সাহেব বিধানচন্দ্রকে সাক্ষী মানলেন—‘আচ্ছা, তুমিই বল, ট্রামটা কি ঘণ্টায় তিরিশ মাইল বেগে যাচ্ছিল না?’
‘না।’ উত্তর দিলেন বিধানচন্দ্র। তিনি বললেন—‘আমার মতে দোষ আপনার কোচম্যানের স্যার, ট্রামের নয়।’ সাহেব রাগে কাঁপতে কাঁপতে ভিতরে চলে গেলেন
সাত দিন পর আবার ডাক পড়ল ছাত্র বিধানচন্দ্রের। কর্নেল পেক্ বললেন—‘তোমাকে আদালতে সাক্ষী দিতে হবে।’
‘দিতে পারি, তবে দুঃখের বিষয় আমার সাক্ষ্য আপনার পক্ষে যাবে না স্যার।’ দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন ছাত্র বিধানচন্দ্র।
কর্নেল পেক্ অপমানে ও রাগে কিছুক্ষণ গুম্ হয়ে বসে থেকে বললেন, ‘আচ্ছা। তুমি যেতে পার।’
এই ঘটনার সাত দিন পরেই পরীক্ষা। লিখিত পরীক্ষা ভালোভাবেই চুকে গেল, এবার মৌখিক পরীক্ষার পালা। পরীক্ষা দেবার জন্য ঘরে ঢুকতেই দেখলেন কর্নেল পেক্ বসে। বিধানচন্দ্রকে দেখেই কর্নেল পেক্ ক্ষেপে গিয়ে চীৎকার করে উঠলেন—‘গেট আউট, গেট আউট।’ অবাধ্য ছাত্রের পরীক্ষা কিছুতেই তিনি নিলেন না। মাথা নীচু করে বেরিয়ে এলেন বিধানচন্দ্র। জীবন-সংগ্রামে সেইটিই তাঁর প্রথম ও শেষ পরাজয়।
বেলা এগারোটা বেজেছে। এবার আমাকে আপিসে বেরোতে হবে। রসা রোডে এসে দেখি ট্রাম-বাস বন্ধ, জনস্রোত বন্যার মতো ছুটে চলেছে রাসবিহারী অ্যাভিনিউর দিকে। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, কিশোর-কিশোরী, দীন-দরিদ্র সাধারণ মানুষ থেকে প্রাসাদোপম গৃহের যাঁরা বাসিন্দা, যাঁরা কদাচ পথচারীদের ভিড়ে নেমে আসেন, আজ তাঁরাও সবাই রাস্তার মানুষদের সঙ্গে এক সত্তায় মিলে গিয়ে চলেছে উদ্গ্রীব আগ্রহে। সবারই চোখে নীরব প্রশ্ন, ভিড়ের মধ্যে কি তাঁকে একবার দেখতে পাবো?
সাদার্ন অ্যাভিনিউর মোড় পার হয়ে আমি আর এগোতে পারিনি। বিপুল জানতার দুর্ভেদ্য প্রাচীর। বাড়ির ছাদ, কার্নিশ, বারান্দা, ফুটপাথ থেকে যানবাহন চলাচলের সদর রাস্তা সব ঢেকে গেছে কালো মাথায়। দুপুরের প্রচণ্ড কড়া রোদ উপেক্ষা করে লক্ষ লক্ষ নরনারী আজ পথে বেরিয়ে পড়েছে। কোনো ক্লেশ, কোনো ক্লান্তি, কোনো কষ্টই তারা গ্রাহ্য করছে না।
সাদার্ন অ্যাভিনিউর মোড়ে একটা গাছের ছায়ায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে শোকহ্বিল জনতার মিছিল দেখছি আর ভাবছি ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বটে, কিন্তু তিনি কোনোদিনই তথাকথিত জনতার নেতা ছিলেন না। অথচ তাঁর এই বিপুল জনপ্রিয়তার মূল কারণটি কি? কারণ বোধহয় তাঁর বিরাট ব্যক্তিত্ব যা ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার সম্পদ এবং যে-সম্পদ এই মানুষটির তিরোধানের সঙ্গে বাংলা দেশ থেকে লুপ্ত হয়ে গেল। রাজনীতিক নেতারূপে নয়, চিকিৎসাবিদ্রূপে এবং অসাধারণ ব্যক্তিত্ব-সম্পন্ন মানুষরূপে জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলা দেশে কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছিলেন। বিধানচন্দ্রের অনেক কাহিনীই আজ শুধু বাংলা দেশ নয়, ভারতবর্ষেরও ঘরে ঘরে প্রচলিত।
১৯১১ সালের জুলাই। বিধানচন্দ্র বিলাত থেকে যেদিন কলকাতায় পৌঁছলেন, তখন তাঁর পকেটে আছে মাত্র পঁচিশ টাকা। তা হোক, তবু তিনি ভারতের মাটিতে পা দেবার আগেই স্থির করে বসে আছেন যে কোনও ওষুধের দোকানে বসে কমিশনের জন্য প্রেসক্রিপশন লিখবেন না। বিশেষ কারও অধীনে চাকরিও করবেন না। ধার-দেনা করে তিনি ৮৪ নম্বর হ্যারিসন রোডের উপর একটি বাড়ি ভাড়া করে ফেললেন। তখন তাঁর দু-দুটি বিলাতী ডিগ্রি—এম আর সি পি এবং এফ আর সি এস। সুতরাং ফী দু’টাকা থেকে বেড়ে হল আট টাকা।
এই অবস্থায় বেশ কয়েকমাস কেটে গেল। পসার তখনও ভালো করে জমেনি, আট টাকাকে ষোল টাকা করার অবস্থা তখনও হয়নি। একদিন এই কলকাতারই এক ধনী ব্যক্তি এসে বললেন—‘আপনাকে আমি আমার পারিবারিক চিকিৎসক নিযুক্ত করতে চাই।’ সেদিনও কলকাতার বনেদি ধনী পরিবারে বিলেত-ফেরত গৃহ-চিকিৎসক রাখাটা ছিল কৌলিন্যের অন্যতম মাপকাঠি।
বিধানচন্দ্র সেটা জানতেন বলেই উত্তর দিলেন—‘মাপ করবেন। আমি কারও—’
আগেই বলেছি কলকাতার বনেদি বাবু-কালচারের ইনিও একজন বিশিষ্ট প্রতিভূ, তাই ছোকরা ডাক্তারের উদ্ধত জবাবে কিঞ্চিৎ মেজাজ দেখিয়েই বললেন—‘জানেন কত পেতেন আপনি?’
‘কত?’ কৌতূহলী বিধানচন্দ্ৰ লোকসানের পরিমাণটা শুনতে চান।
‘বছরে দেড়শ টাকা।’ ভদ্রলোক টাকার অঙ্কটা এমন ভঙ্গিতে বললেন যেন শুনেই ডাক্তারের চোখ ছানাবড়া হয়।
টাকার অঙ্ক শুনেই বিধানচন্দ্র প্রচণ্ড শব্দ করে হেসে উঠলেন।