‘বেশ, তোমার মেয়ে বা বৌমাকে বোলো রোজ বিকেলে ওঁকে হাঁটিয়ে মন্দিরে নিয়ে যেতে। মন্দির দর্শনও হবে, ওখানে শুনেছি রোজ সন্ধ্যায় কথকতা আর কীর্তন গান-টান হয় তাও ভক্তিভরে শুনবেন, ঘণ্টাখানেক বাদে আবার ওঁকে হাঁটিয়ে বাড়ি নিয়ে আসবে। ওইটুকু পথ রোজ একবার হেঁটে যাওয়া-আসা করলেই ওঁর হজমশক্তি ফিরে পাবেন। ওষুধে আর কাজ নেই।’
ডাঃ রায়ের কাছ থেকে বিদায় নেবার আগে বৈদ্যনাথ বললে—‘আমার ট্রান্সফারের কথাটা আর একবার মনে করিয়ে দিলাম স্যার।’
ডাঃ রায় ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, ‘তাই তো হে, ও-কথাটা তো আমি বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলাম। এক কাজ করো। টেবিলের উপর ক্যালেণ্ডারটার পাতায় আগামী কালের তারিখে লিখে রাখো।’
বৈদ্যনাথ ডেস্ক ক্যালেণ্ডারে সোমবারের পাতাটা ওল্টাতেই দেখল এনগেজমেন্ট-এ ভর্তি। আরেকটা লাইন লিখবার জায়গা পর্যন্ত নেই। সব শেষে এক চুল পরিমাণ জায়গায় ক্ষুদে ক্ষুদে অক্ষরে লিখে দিল—Transfer of Baidyanath from Asansol to Calcutta.
এরপরে বেশ কয়েক মাস ডাঃ রায়ের সঙ্গে বৈদ্যনাথের আর দেখা— সাক্ষাৎ হয়নি। নানা রকম কাজের চাপে ছুটির দিনেও ডাঃ রায়কে ব্যস্ত থাকতে হয়, অনেক সময় আপিসের কাজে টুরে যেতে হয় বলে বৈদ্যনাথের ছুটির দিনে কলকাতায় আসা সম্ভব হয় না। কিন্তু ডাঃ রায়ের সঙ্গে চিঠিপত্র লেখালেখি নিয়মিতই হয়।
॥ বারো ॥
১৯৬২ সালের জুন মাস। বৈদ্যনাথ আপিসের কাজে বিহার অঞ্চলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাটনায় এসে হঠাৎ সে খবরের কাগজে দেখল ডাঃ রায় অসুস্থ! অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন, হার্ট-এর ট্রাবল। ডাক্তাররা নির্দেশ দিয়েছেন সম্পূর্ণ বিশ্রাম নিতে।
খবরটা পড়েই বৈদ্যনাথের মনে একটা অমঙ্গলের ছায়া ঘনিয়ে এল। ইলেকশনের সময় ডাঃ রায়কে যে-রকম অমানুষিক পরিশ্রম করতে দেখেছে বৈদ্যনাথ, তখনই তার মনে আশংকা দেখা দিয়েছিল যে এই বয়সে এই ধকল ওঁর পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হবে কি না। খবরটা পড়ে আর স্থির থাকতে পারেনি বৈদ্যনাথ। সেদিনই চলে এল আসানসোল।
পরদিন ছিল শনিবার। বিকেলের গাড়িতে কলকাতায় পৌঁছেই হাওড়া স্টেশন থেকে ডাঃ রায়ের বাড়িতে টেলিফোন করে জানতে পারল যে তাঁর অবস্থা আপাতত অনেকটা ভাল, তবে শয্যাশায়ী। ডাক্তাররা বলেছেন পূর্ণ বিশ্রাম নিতে।
পরদিন যথারীতি দুপুরে বৈদ্যনাথ ডাঃ রায়ের সঙ্গে দেখা করবার জন্য ওয়েলিংটন স্কোয়ারের বাড়িতে চলে গেল। শোবার ঘরে পিঠের তলায় দুটো বালিশ দিয়ে শুয়ে আছেন ডাঃ রায়। বিছানার একপাশে একটা টেবিলে এক গাদা ফাইল, তারই একটা টেনে নিয়ে মনোযোগ সহকারে দেখছেন। আসবার সময় নিউ মার্কেট থেকে সাদা গোলাপফুলের একটা তোড়া নিয়ে গিয়েছিল বৈদ্যনাথ। ফুলের গুচ্ছ হাতে বৈদ্যনাথকে ঘরে ঢুকতে দেখেই ফাইলটা টেবিলের উপর রেখে ডাঃ রায় বললেন—‘রোগীর ওষুধ হাতে তুমি এসে গিয়েছ বৈদ্যনাথ, ভালই হয়েছে।’
ফুলদানিতে গোলাপগুচ্ছ সাজিয়ে রেখে ডাঃ রায়ের বিছানার পাশে এসে দাঁড়াতেই ডাঃ রায় বললেন—‘চেয়ারটা টেনে এনে আমার কাছে এসে বসো। এতক্ষণে মন খুলে কথা বলবার লোক পেলাম।’
বৈদ্যনাথ একটা চেয়ার টেনে ডাক্তার রায়ের বিছানার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল—‘আপনার কিন্তু স্যার বেশী কথা বলা নিষেধ। ডাক্তার ব্যানার্জি সেই নির্দেশই সবাইকে দিয়ে গিয়েছেন শুনলাম।’
মৃদু হেসে ডাঃ রায় বললেন—‘রামমোহন রায়ের একটা গান মনে পড়ে বৈদ্যনাথ। “মনে করো শেষের সে দিন ভয়ঙ্কর। অন্যে সবে কথা কবে তুমি রবে নিরুত্তর।” আমার হয়েছে সেই দশা। অন্যে সবে আমার উপর ডাক্তারী ফলাচ্ছে, আমিই রব নিরুত্তর।’
বৈদ্যনাথ বললে—‘এতকাল আপনি সকলের উপর ডাক্তারী করেছেন, এবার সকলে সুযোগ পেয়েছে আপনার উপর ডাক্তারী করবার। এখন আর আপনি ডাক্তার নন, রুগী। রুগীকে ডাক্তারের কথা মেনে চলতে হবে বইকি।’
ডাক্তার রায় হেসে বললেন—‘কাল পদ্মজাও এসে এই কথাই আমাকে শুনিয়ে গেল। বললে—এতকাল আমরা তোমার কথা শুনে এসেছি, এবার তোমাকে আমাদের কথা শুনতে হবে। আরও বললে—তুমি চীফ মিনিস্টার হতে পার, তবে আমি যে তোমার গভর্নর সেটা ভুলে যেও না। গভর্নেসও বলতে পারো আমাকে, সুতরাং আমার কথা শুনতে তুমি বাধ্য।’ বলতে বলতে রোগযন্ত্রণা ভুলে গিয়ে ডাঃ রায় সরবে হেসে উঠলেন।
বৈদ্যনাথ বলল—‘উনি তো ঠিক কথাই বলেছেন, কিন্তু আপনি তো দেখছি আপনার দফতর নিয়ে এসেছেন বিছানার পাশে।’
ডাঃ রায় কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন—‘দেখো বৈদ্যনাথ, আমার আরোগ্যের একমাত্র উপায় এই সব কাজ নিয়ে থাকা। স্বপ্ন আমি দেখি না কিন্তু সংকল্প আমার অনেক। তার কিছু পালন করতে পেরেছি, এখনো অনেক বাকি।’
বৈদ্যনাথ বলল—‘কিন্তু স্যার, অসুস্থ শরীর নিয়ে আপনার এইসব কাজ এখন না করাই ভালো। সম্পূর্ণ বিশ্রাম দেওয়া দরকার।’
দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ডাঃ রায় বললেন—‘বিশ্রাম, বিশ্রাম, বিশ্রাম। কানের কাছে সব সময় শুনছি বিশ্রাম নিন, বিশ্রাম নিন। বিশ্রাম তো আমি একদিন নেবই, অনন্তকালের জন্য বিশ্রাম। বোধহয় সে দিনের আর বেশি দেরি নেই। তবে কি জানো, কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে পারলেই আমার মন ভাল থাকে।’
‘কিন্তু শরীর তা মানবে কেন!’