ঐ একটি ব্যাপারে বৈদ্যনাথের সত্যিই সংকোচ অপরিসীম। অতবড় ডাক্তার হাতের নাগালে থাকা সত্ত্বেও বৈদ্যনাথ কোনোদিন নিজের পারিবারিক চিকিৎসার জন্য ডা: রায়ের কাছে যায়নি। পাড়ার হিতাকাঙ্ক্ষীদের কথায়, খানিকটা মায়ের অনুরোধেও—সে সমস্ত কাগজপত্র ও যাবতীয় প্রেসক্রিপশন নিয়ে রবিবার দুপুরে চলে গেল ডাঃ রায়ের বাড়ি। সেখানে গিয়েই শুনল ডাঃ রায় আজ সেক্রেটারিয়েট-এ গিয়েছেন, জরুরী কাজে। বৈদ্যনাথকে কাল ভোরেই চলে যেতে হবে আসানসোল। সুতরাং আজই, ছুটির দিনেই বিকেলে ডাঃ রায়কে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। বৈদ্যনাথ সোজা চলে গেল রাইটার্স বিল্ডিং। রাইটার্স বিল্ডিং-এ ছুটির দিনেও বৈদ্যনাথ দেখল সারি দিয়ে রয়েছে অনেক গাড়ি। নিচে লিফটের কাছে পুলিস সার্জেন্ট দাঁড়িয়ে, তার কাছে অনুমতি চাইল দোতলায় উঠে ডাঃ রায়ের সঙ্গে দেখা করবার।
সার্জেন্ট জানিয়ে দিল আজ ডাঃ রায়ের ঘরে ক্যাবিনেটের জরুরী মিটিং চলছে, সুতরাং আজ দেখা হবার কোনো উপায় নেই। বৈদ্যনাথ অনেক অনুরোধ উপরোধ জানাল, সার্জেন্ট কিছুতেই রাজী হল না। সে বললে— ‘আপনার কথায় আপনাকে নিয়ে যাই, আর আমার চাকরিটাও যাক।’
বৈদ্যনাথ বিশেষ জোর দিয়েই বললে—‘আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, আপনার কোন ক্ষতিই হবে না।’
সার্জেন্ট হেসে বললে—‘আপনি কোথাকার লাট সাহেব মশাই যে আপনার কথায় বিশ্বাস করে আপনাকে উপরে নিয়ে যাব!’
বৈদ্যনাথ তখন অনুনয়ের সুরে সার্জেন্টকে বললে—‘বেশ, আমাকে না— হয় না-ই নিয়ে গেলেন। আমার হাতের এই কাগজপত্রগুলি দয়া করে ওঁকে একবার যদি দেখান, তা হলেই হবে।’
সার্জেন্ট তাতেও গররাজি। সে বলল—‘দেখুন, ডাঃ রায় এখন জরুরী ক্যাবিনেট মিটিং-এ বসেছেন। আজই বিকেলের প্লেন-এ যাচ্ছেন দিল্লি। সুতরাং এখন আপনার এই কাগজপত্র দেখবার ফুরসতই পাবেন না। আপনি পরে আরেকদিন সেক্রেটারির সঙ্গে কথাবার্তা বলে যখন আসতে বলবেন সেই সময় চলে আসুন। জরুরী কাজের সময় আপনার কাগজপত্র নিয়ে ডাঃ রায়ের কাছে হাজির করার দায়িত্ব আমি নিতে পারি না, ও কাজ আমার এক্তিয়ারের মধ্যে নয়।’
বৈদ্যনাথ এবার সত্যিই চিন্তায় পড়ে গেল। ফিরেই যেতে হবে? হঠাৎ কী মনে করে সার্জেন্টকে বললে—‘দেখুন, আমার মায়ের খুবই সঙ্কটাপন্ন অবস্থা। সব ডাক্তাররাই আশা ছেড়ে দিয়েছেন। ওঁর কাছে ছুটে আসার একমাত্র কারণ একবার শেষ চেষ্টা করে দেখা। আপনি শুধু এই রিপোর্টটা ওঁর হাতে দিন। সময়াভাবে যদি ফেরত পাঠিয়ে দেন, তাতেও আমার মনে কোনো ক্ষোভ থাকবে না। সান্ত্বনা পাব এই ভেবে যে আমার দিক থেকে চেষ্টার কোনো ত্রুটি করিনি।’
এ কথা শুনে সার্জেন্টের মন নরম হল। বললেন—‘দিন আপনার কাগজপত্র। ওঁর হাতে তো দিই, তারপর যা হয় হবে।’
বৈদ্যনাথকে দাঁড় করিয়ে রেখে কাগজপত্রগুলি হাতে করে সার্জেন্ট উপরে চলে গেল।
প্রায় মিনিট কুড়ি পরে সিঁড়ি দিয়ে লাফাতে লাফাতে সার্জেন্ট নেমে এল। বললে—‘আশ্চর্য কাণ্ড মশাই, মিনিস্টারদের সঙ্গে জোর আলোচনা চলছে, তারই মধ্যে সেলাম ঠুকে কাগজটা ওঁর হাতে ধরিয়ে দিলাম। কাগজে আপনার নাম ও আপনার মায়ের নাম দেখেই সব কাজ ও আলোচনা ফেলে অত্যন্ত নিবিষ্ট হয়ে রিপোর্ট পড়লেন, প্রেসক্রিপশনগুলি দেখলেন, তারপর রিপোর্টের পাশে ওঁর মন্তব্য লিখলেন। ততক্ষণ অন্যান্য মিনিস্টাররা সব গালে হাত দিয়ে চুপ করে বসে।’
বৈদ্যনাথ দেখল রিপোর্টের কাগজটার একপাশে খালি জায়গাটায় রুগীর চিকিৎসা সম্পর্কে কি করতে হবে তার দীর্ঘ ফিরিস্তি দিয়ে কয়েকটা ইনজেকশন আর ওষুধের প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়েছেন। সব শেষে ব্যক্তিগতভাবে দুঃখ জানিয়ে বৈদ্যনাথকে লিখেছেন যে, আজই সন্ধ্যা ছ’টায় ওঁকে দিল্লির প্লেন ধরতে হবে, তাই বৈদ্যনাথের মাকে দেখতে যাওয়া সম্ভব হল না। এই ইনজেকশন ও ওষুধ দিন সাতেক চালাবার পর মা কেমন থাকেন যেন ওঁকে অবশ্যই জানানো হয়। প্রয়োজন হলে তখন নিজে গিয়ে রুগী দেখে আসবেন।
বৈদ্যনাথ কৃতজ্ঞ চিত্তে বাড়ি ফিরে এল। বাড়ির ডাক্তারকে সব বুঝিয়ে দিয়ে সে পরদিন সকালে চলে গেল আসানসোল। পরের শনিবার এসে বৈদ্যনাথ দেখে ওর মা অনেকখানি সুস্থ হয়ে উঠেছেন। শুধু তাই নয়, বিছানায় উঠে বসে হাসিমুখে নাতি-নাতনীর সঙ্গে হাসি-মস্করা করছেন। ডাক্তার বললে, রুগীর অবস্থা বেশ ভাল, ক্রমশই আরোগ্যের পথে।
রবিবার সকালে বৈদ্যনাথ চলে গেল ডাঃ রায়ের বাড়ি। দেখা করতেই ডাঃ রায় নিজেই বললেন—‘তোমার মা তো ভালই আছেন মনে হচ্ছে, অন্তত তোমার মুখ তাই বলছে।’
বৈদ্যনাথ বললে—‘একটা সুযোগ পেয়েছিলাম আপনাকে আমার বাড়ি নিয়ে যাবার, সে সুযোগও আপনি আমায় দিলেন না।’
ডাঃ রায় হেসে বললেন—‘দিলে তুমি খুশি হতে না নিশ্চয়। মা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠুন, তখন যাবো একদিন তোমার বাড়ি। তবে হ্যাঁ, পাড়াসুদ্ধ লোককে আগে থাকতে আবার জানিয়ে রেখো না। তা হলে পালিয়ে আসতে হবে।
মায়ের জন্য নতুন করে ওষুধপথ্যির ব্যবস্থা লিখে দেবার অনুরোধ জানাতেই ডাঃ রায় বললেন—‘আর কোনো ওষুধের দরকার নেই, ইনজেকশনেরও না। আচ্ছা, তোমার বাড়ি থেকে বাওয়ালী মণ্ডলের রাস মন্দিরটা কতদূর?’
‘বেশী দূর নয়, সোয়া মাইল পথ হবে।’