ডাঃ রায় আবার গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন—‘খুব অন্যায় করেছে বৈদ্যনাথ। আচ্ছা, তুমি আমার এখানে একটা কাজ নেবে? স্টেট ট্রান্সপোর্টে আমার একজন বিশ্বস্ত লোক দরকার। তুমি যদি এ-কাজটা নাও আমি নিশ্চিন্ত হই।’
বৈদ্যনাথ বললে—‘না। সরকারী চাকরি আমি নেব না। আপনার সঙ্গে আমার পিতাপুত্র সম্পর্ক। সে সম্পর্ক আমি নষ্ট হতে দিতে চাইনে।’
ডাঃ রায় চুপ করে রইলেন, কোনো কথা নেই। বৈদ্যনাথ বললে— ‘এবার আমি যেতে পারি স্যার?’
‘হ্যাঁ, তুমি যেতে পারো। তবে একটা কাজ তোমাকে করতে হবে। ওষুধের কোম্পানি সম্বন্ধে তোমার যা-কিছু অভিযোগ তা লিখিতভাবে আমাকে তুমি পাঠিয়ে দিও। আরেকটা কথা। যদি কখনো কোনো প্রয়োজন হয় অসংকোচে তা জানাবে।’
বৈদ্যনাথ বললে—‘আমার একটা শুধু অনুরোধ আছে আপনার কাছে। চাকরির চেষ্টা আমি নিজেই করব, তবে আপনার নাম করে যদি পরিচয় দিই আপনার আপত্তি হবে না তো?’
ডাঃ রায় বললেন—‘কোনো আপত্তি নেই। প্রয়োজন হলে কাউকে যদি কিছু বলে দিতে হয় আমায় জানিও।’
বৈদ্যনাথ আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, মনের সব গ্লানি ওর মুছে গেছে।
খবরের কাগজের ওয়ান্টেড কলম দেখে দেখে বৈদ্যনাথ গিয়ে হাজির হল এক বিলিতি তেল কোম্পানির আপিসে। বেয়ারার হাতে একটা চিরকুট লিখে জানালে যে সে ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের কাছ থেকে এসেছে, বড় সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে চায়।
সঙ্গে সঙ্গে বৈদ্যনাথের ডাক পড়ল বড় সাহেবের ঘরে। কী ব্যাপার? বৈদ্যনাথও বললে যে সে কাগজে বিজ্ঞাপন পড়ে জেনেছে একজন অ্যাসিস্টেন্ট সেলস্ ম্যানেজার প্রয়োজন, সে সেই পদে চাকরিপ্রার্থী।
বড় সাহেব এই যুবকের দুঃসাহসিক অভিযানে বিরক্ত না হয়ে কৌতুক বোধ করলেন। জিজ্ঞাসা করলেন—‘তোমার কোয়ালিফিকেশন?’
‘ম্যাট্রিক পাস।’
‘এ-কাজে যে গ্র্যাজুয়েট ছাড়া নেওয়া হবে না বিজ্ঞাপনে তা লেখা আছে দেখোনি?’
‘দেখেছি। তবু আমি সাহস করে এসেছি এই কারণে যে এ ধরনের কাজে আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে এবং আমার বিশ্বাস যোগ্যতার সঙ্গেই এ-কাজ আমি করতে পারব।’
বড় সাহেব ঘণ্টা বাজিয়ে আপিস ম্যানেজারকে ডেকে পাঠিয়ে বৈদ্যনাথের নাম ঠিকানা সমেত একটা অ্যাপ্লিকেশন লিখিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়ে ছেড়ে দিলেন। দিন সাতেক বাদেই বৈদ্যনাথের নামে তেল—কোম্পানির বড় সাহেবের চিঠি এসে হাজির। তাকে চাকরিতে নিয়োগ করা হল। মাইনে ৩০০ টাকা। অ্যাসিস্টেন্ট সেলস্ মানেজারের পোস্ট। চাকুরিস্থল আসানসোল। ফ্রি কোয়ার্টার। নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, পয়লা তারিখে আসানসোল আপিসে রিপোর্ট করতে হবে। সেখানেও এই মর্মে নির্দেশ দেওয়া হল।
চিঠি পেয়েই পরের রবিবার সকালে বৈদ্যনাথ ডাঃ রায়ের বাড়ি হাজির। চিঠি দেখে ডাঃ রায় হাসতে হাসতে বললেন—‘আমি জানি চিঠি তোমার কাছে যাবে। সাহেব টেলিফোন করে তোমার কথা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমার যা বলবার বলে দিয়েছি। কাজটা পেয়ে খুশি তো?’
কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল বৈদ্যনাথের মন। বললে—‘এ আমার কল্পনার অতীত। কিন্তু—’
‘এর মধ্যে আবার কিন্তু কেন? লেগে যাও কাজে।’
‘কিন্তু স্যার, কলকাতা ছেড়ে আসানসোল যেতে মন চাইছিল না। তাছাড়া ওখানে গেলে আপনার সঙ্গে দেখা হবার সুযোগ কমে যাবে!’
ডাঃ রায় হেসে বললেন—‘কলকাতায় থেকেই বা আমার সঙ্গে ক’দিন তোমার দেখা হয়। ভুল কোরো না, আসানসোলেই যাও। ওখানে খরচ কম, ফ্রি কোয়ার্টার পাচ্ছ, ছেলেমেয়েদের এডুকেশন ফ্রি, জিনিসপত্রের দাম কলকাতার থেকে সস্তা। খোলামেলা জায়গায় স্বাস্থ্যও ভালো থাকবে। আমার সঙ্গে দেখা করা? সে তো যে-কোনো ছুটির দিন এলেই দেখা হতে পারে।’
আসানসোল যাওয়া স্থির করে বৈদ্যনাথ ডাঃ রায়ের কাছ থেকে চলে এল। আসবার আগে শুধু একটি কথা তিনি বলে দিলেন—‘কাজে কখনো আলস্য প্রকাশ কোরো না। দেখো, এবার যেন আমার মুখে চুনকালি না পড়ে।’
॥ এগারো ॥
বেশ কয়েক বছর পার হয়ে গেছে। বৈদ্যনাথ এখন সুপ্রতিষ্ঠিত। সেলস্ ম্যানেজার রিটায়ার করার পর বৈদ্যনাথকে সেই পদে বহাল করা হয়েছে, এখন তার মাইনে সাত শ’ টাকা। তাছাড়া বছরে মোটা টাকার বোনাস, তদুপরি কমিশন আছেই। টালিগঞ্জ অঞ্চলে বৈদ্যনাথ কয়েক বছর আগে একটা জমি কিনেছিল, এখন সে সেখানে বাড়ি তুলেছে। একতলা ছোট্টো সাজানো গুছোনো বাড়ি, সামনে খোলা জমিতে দেশী ফুলের মনোরম বাগান। মা, স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা এখন কলকাতায় থাকে, বৈদ্যনাথ প্রতি শনিবার কলকাতায় আসে। রবিবার সকালটা ডাঃ রায়ের বাড়িতে কাটিয়ে পরদিন ভোরের ট্রেনে আসানসোল ফিরে যায়। কলকাতায় ট্রান্সফারের চেষ্টা করছিল বৈদ্যনাথ। ডাঃ রায়কেও অনুরোধ জানিয়ে গেল যদি তিনি একটু বলে দেন।
বৈদ্যনাথ আজ জীবনে প্রতিষ্ঠিত, সে আজ সফল, সুখী। তার সব আকাঙ্ক্ষাই আজ পূর্ণ, শুধু একটি সাধ তার আজও অপূর্ণ থেকে গেছে। ডাঃ রায়কে ওর বাড়িতে নিয়ে আসার বাসনা তাঁর বহুদিনের। তিনি নিজেই একদিন বলেছিলেন—‘তুমি নিজে বাড়ি করো, তখন যাবো।’
আসানসোল থেকে কলকাতায় নিজেদের বাড়িতে আসার পর থেকে বৈদ্যনাথের মায়ের শরীর ভালো যাচ্ছিল না। কিছু খেলেই পেটে অসহ্য যন্ত্রণা। খাওয়ার পরই সব বমি হয়ে যায়, কিছুই হজম হয় না। পাড়ার ডাক্তারদের দিয়ে অনেক চিকিৎসা করালো। কিছুদিনের মতো উপশম হয়, আবার বাড়াবাড়ি। পাড়ার পরিচিত লোকরা বৈদ্যনাথকে বললে—‘ডাঃ রায়কে ডেকে আপনার মাকে একবার দেখান। এতে সংকোচের কী আছে!’