ডাঃ রায় হাতের ইশারায় বৈদ্যনাথকে কাছে ডাকলেন। বৈদ্যনাথ সশংকিত চিত্তে এগিয়ে এল। ডাঃ রায় শুধু বললেন—‘গাড়িতে উঠে বোসো।’
নিঃশব্দে বৈদ্যনাথ সামনে ড্রাইভারের পাশে উঠে বসল। পুলিস ভ্যানের সিপাহীর দল ফ্যাল ফ্যাল করে বৈদ্যনাথের দিকে তাকিয়ে। গাড়িতে যেতে যেতে ডাঃ রায় কোনো কথা বললেন না, খুবই গম্ভীর। রাইটার্স বিল্ডিং-এ এসে গাড়ি থামতেই ডাঃ রায় আবার মুখ খুললেন— ‘আমার সঙ্গে এসে বৈদ্যনাথ।’
বৈদ্যনাথকে নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকবার সময় ডাঃ রায় তাঁর খাস বেয়ারাকে বলে দিলেন যেন ওঁর ঘরে এখন কেউ না ঢোকে। যে দরজা একদিন নিজের হাতে বন্ধ করে এই কামরা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল বৈদ্যনাথ, এবার সে দরজার পর্দাটা ডাঃ রায় নিজের হাতে তুলে বৈদ্যনাথকে ভিতরে আসতে বললেন।
নিজের চেয়ারে বসে ডাঃ রায় প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন—‘তোমাকে আমি বলে দিয়েছিলাম যে আমার সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা করবে না।’
বুকভরা অভিমান জমিয়ে রেখেছে বৈদ্যনাথ এতদিন ধরে, এবার তা প্রকাশ হতে লাগল। সে বললে—‘আমি তো আপনার সঙ্গে দেখা করতে যাইনি।’
‘তাই যদি হবে, আমি রোজ বেরোবার সময় ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকতে কেন?’
বৈদ্যনাথ আগের মতোই অভিমানী কণ্ঠে বললে—‘কলকাতা শহরের যে-কোনো ফুটপাথে যে-কোনো নাগরিকের দাঁড়াবার অধিকার আছে বলেই আমি জানি। অবশ্য যদি সেটা প্রোটেকটেড এরিয়া না হয়।’
ডাঃ রায় এবার হেসে বললেন—‘যাক, নাগরিক অধিকার সম্পর্কে তোমার জ্ঞান দেখছি টনটনে! তাহলে আনলাইসেন্সড্, পিস্তল নিয়ে তোমার আপিসের লোককে ওভাবে মারতে গিয়েছিলে কেন? অবশ্য আমি শুনেছি যে পিস্তলে গুলি ভরা ছিল না। কিন্তু পিস্তলটাই বা তুমি পেলে কোথায়?’
বৈদ্যনাথ বললে—‘পিস্তল কোথায় পাওয়া যায় আপনি ভা ভালো করেই জানেন, তবু কেন আমায় জিজ্ঞাসা করছেন।’
ডঃ রায় গম্ভীর হয়ে বললেন—‘হুঁ বুঝেছি। তা কত টাকায় কিনেছিলে?’
‘দু’শো টাকায়।’
ডাঃ রায় অবাক হয়ে বললেন—‘তোমার সামান্য আয়, তুমি দু’শো টাকা দিয়ে পিস্তল কিনতে গেলে কেন?’
এবার বৈদ্যনাথ ডাঃ রায়কে আদ্যোপান্ত সব ঘটনা খুলে বলল। তারপর বলল—‘আমার মনে একটা সন্দেহ দেখা দিয়েছিল যে করনক্ আমাকে গুণ্ডা লাগিয়ে শায়েস্তা করবার মতলব করছে। বালীগঞ্জ সার্কুলার রোডের দোকানে কাজ সেরে অনেক রাত্রে নির্জন অন্ধকার রাস্তা দিয়ে প্রায়ই আমাকে হেঁটে বাড়ি ফিরতে হত। আত্মরক্ষার জন্যই এই পিস্তলটি আমি সংগ্রহ করেছিলাম।’
সব শুনে ডাঃ রায় আবার বললেন—‘তোমার কি সত্যিই উদ্দেশ্য ছিল আপিসের লোকটাকে খুন করার? না কি শুধু ভয় দেখাতেই চেয়েছিলে!’
‘খুন করতেই চেয়েছিলাম স্যার। তখন রাগ মাথায় এত চড়ে গিয়েছিল যে, পোর্টফোলিও ব্যাগের অন্য খোপে যে গুলি আছে তা পিস্তলে ভরে নেবার খেয়ালই হয়নি।’
একথা শুনে ডাঃ রায় স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। বিস্মিত হয়ে বললেন— ‘তুমি খুন করতেই চেয়েছিলে? ছিঃ বৈদ্যনাথ, ছিঃ।’
বৈদ্যনাথ বললে—‘আপনি আমাকে ধিক্কার দিতে পারেন কিন্তু উত্তেজনার যথেষ্ট কারণ ছিল বলেই আমি তাকে খুন করতে গিয়েছিলাম।’
ডাঃ রায় বিস্মিত হয়ে বললেন—‘কী এমন কারণ থাকতে পারে যে তুমি তোমার আপিসের একজন পদস্থ কর্মীকে খুন করবে।’
চুপ করে রইল বৈদ্যনাথ।
ডাঃ রায় আবার বললেন—‘চুপ করে রইলে যে, বলো।’
বৈদ্যনাথ গম্ভীর হয়ে বলল—‘সে জানে আপনার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক। সে জানে আমি আপনার লোক, আপনার রেকমেণ্ডেশনে আমি ওখানে চাকরি পেয়েছি। তা সত্ত্বেও তার এতবড় দুঃসাহস, সে আমার মুখের উপর আপনার নামে জঘন্য কুৎসা বলে যাবে?’
বৈদ্যনাথের কথা শেষ হতে না হতেই ডাঃ রায় প্রচণ্ড শব্দে হেসে উঠলেন, সে-হাসি আর থামে না। বৈদ্যনাথ অবাক হয়ে গেছে ডাঃ রায়ের এই দমকা হাসি শুনে। তখনো ডাঃ রায় হাসছেন, হাসতে হাসতে বললেন—‘এইজন্যে তুমি মানুষ খুন করতে গেলে? এ-ব্যাপারে তুমি বাংলাদেশে খুন করার মতো হাজার হাজার লোক পাবে। বহুকাল ধরেই আমার নামে অনেক কুৎসাই লোকমুখে রটনা হচ্ছে। ইদানীং তোমাদের মুখ্যমন্ত্রী হবার পর সেটা বেড়েছে বই কমেনি।’
বৈদ্যনাথ বললে—‘আপনি কথাটা হেসে উড়িয়ে দিতে পারেন, কিন্তু আমি পারি না।’
ডাঃ রায় বললেন—‘থাক, তোমার আর খুনখারাপির মধ্যে গিয়ে দরকার নেই। বারবার তোমার হয়ে জামিন নিতে পারব না বাপু। কুৎসা রটনাকারীরা বলবে আমিই তোমাকে এ-কাজে লাগিয়েছি।’
বৈদ্যনাথ এতক্ষণে বুঝতে পারল যে ডাঃ রায়ের মন থেকে ওর প্রতি পুঞ্জীভূত ঘৃণার রেশ খানিকটা অপসারিত হয়েছে। এইটুকুই ওর কাম্য ছিল। হাতজোড় করে নমস্কার জানিয়ে বৈদ্যনাথ বলল—‘আপনার কাজের অনেক ক্ষতি করলাম, এবার আমি যাই।’
ডাঃ রায় বললেন—‘কিন্তু একটা কথা তো কিছুই আমাকে বললে না, তুমি কী করছ এখন।’
‘কিছুই নয়। চেষ্টাচরিত্র করেছিলাম, মনের মতো কাজ পাইনি, আর পেলেও মাইনে দিতে চায় নিতান্ত কম।’
‘সংসার চলছে কি করে?’
‘শৌখিন জিনিস দু-চারটে করেছিলাম, তা বেচে দিয়েছি। তাছাড়া গয়না কিছু ছিল স্ত্রীর কাছে, এখন তাই বিক্রী করে চলছে।’
ডাঃ রায় কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন—‘ছেলেমেয়ে দুটির কী অবস্থা?’
বৈদ্যনাথ বললে—‘তাদের দিকে তাকানো যায় না। হাড়-জিরজিরে হয়ে গেছে। আজ তিন মাস চাকরি নেই, ওদেরই বা খাওয়াব কি।’