বৈদ্যনাথ নম্র কাতর কণ্ঠে বলল—‘আমার কথাটা একবার শুনবেন স্যার?’
ডাঃ রায় আরো গম্ভীর গলায় বললেন—‘আমি তোমার কোনো কথাই আর শুনতে চাই না। তুমি আমার সামনে থেকে এখনি চলে যাও।’
ডাঃ রায়ের চোখে মুখে একটা তীব্র বিরক্তি। বৈদ্যনাথ বুঝল ডাঃ রায়ের কাছে আর সে স্নেহের পাত্র নয়, ঘৃণার পাত্র। তবু আরেকবার সাহস করে বলল—‘আপনি আমার একটা কথাও কি শুনবেন না স্যার?’
‘না, একটা কথাও না।’ বজ্রকঠোর কণ্ঠের আদেশ। ‘তোমার সঙ্গে আর আমার কোনো সম্পর্ক নেই, থাকতে পারে না। তুমি যেতে পার।’
বৈদ্যনাথ নীরবে মাথা নীচু করে দরজা খুলে বেরোতে যাবে, ডাঃ রায় কাগজের উপর থেকে মুখ না তুলেই বললেন—‘যাবার আগে আর একটা কথা শুনে যাও। আর কোনদিন আমার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করো না।’ একটু থেমে চাপা অথচ দৃঢ়স্বরে বললেন—‘যাবার সময় দরজাটা নিজের হাতে বন্ধ করে চলে যেও।’
ডালহৌসি স্কোয়ারের রাস্তায় বেরিয়ে বৈদ্যনাথ বুঝতে পারল ডাঃ রায়ের দরজা তার কাছে চিরকালের মতো বন্ধ হয়ে গেল। বিকেল পাঁচটা বেজে গিয়েছে। আপিস ছুটির পর বাড়ি ফেরার তাগাদায় লোকজন ব্যস্ত হয়ে ছুটে চলেছে, বাড়ি ফেরার কোনো তাড়া বা তাগাদা নেই শুধু বৈদ্যনাথের।
রাইটার্স বিল্ডিং-এর পূর্ব পাশের গির্জার রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল বৈদ্যনাথ। আজ এই জনাকীর্ণ শহরে সে নিঃসঙ্গ, অসহায়, আশাহত। সামনে অন্ধকার ভবিষ্যৎ, পিছনে ফেলে এল এক বিশাল মহীরুহের স্নেহাচ্ছাদন। কোথায় যাবে সে, তার গন্তব্য স্থল সে হারিয়েছে। সামনে কয়েক পা হেঁটে গেলেই ওষুধ কোম্পানির হেড আপিস। সে দরজাও চিরকালের মতো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ঘরে ফেরার আজ আর কোনো তাড়া নেই। ঘরে ফিরে মা’র কাছে, স্ত্রীর কাছে, পুত্র-কন্যাদের কাছে সে মুখ দেখাবে কি করে? চোখের সামনে বিরাট শূন্যতা নিয়ে কার্জন পার্কের নির্জন কোণায় চুপচাপ বসে রইল বৈদ্যনাথ।
১০. বৈদ্যনাথ হাল ছাড়েনি
॥ দশ ॥
বৈদ্যনাথ হাল ছাড়েনি, হার মানতে সে রাজী নয়। আরেকবার সে তার ভাগ্যের সঙ্গে লড়াই করে দেখতে চায়। পরদিন থেকে সকালে সে বেরিয়ে যায়, ফেরে অনেক রাত্রে। কোথায় যায়, কোথায় ঘোরে, বাড়িতে সে কিছুই বলে না। যখন ফেরে শ্রান্ত ক্লান্ত অবসন্ন বৈদ্যনাথের তখন আর কথা বলবার মতো মনের অবস্থা নয়। এমনি করেই চাকরির ব্যর্থ চেষ্টায় তিন মাস কেটে গেল। মা আবার নীরবে চোখের জল ফেলেন, স্ত্রী দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে সমবেদনা জানায়। সংসারের এই থমথমে ভাব ছেলেমেয়ে দুটিকেও মুহ্যমান করে ফেলেছে। এই তিন মাসেই বৈদ্যনাথের চেহারা অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। সঞ্চয় সামান্য যা-কিছু ছিল তা নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। শখ করে যে পাখা রেডিও কিনেছিল, একে একে সেগুলি বিক্রী করে দিয়েছে, এবার টান পড়েছে বৌ-এর গয়নার উপর।
ডাঃ রায়ের কথা একদিনও বৈদ্যনাথ ভোলেনি। প্রচণ্ড অভিমান নিয়ে সেদিন সে ডাঃ রায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল। অভিমান এই জন্যে যে তার কথা ডাঃ রায় কিছুতেই শুনলেন না। অপরাধটাকেই বড় করে দেখলেন, অপরাধের কারণটা জানতে চাইলেন না। একটা ভুল ধারণার জন্য তার জীবনদাতা ডাঃ রায়ের কাছে সে চিরদিনের মতো ঘৃণার পাত্র হয়েই থাকবে, এই মানসিক যন্ত্রণা তাকে অস্থির করে তুলছিল। বৈদ্যনাথ এটুকু জানত যে একবার যদি ডাঃ রায়কে সে সব কিছু বলবার সুযোগ পেত তা হলে নিশ্চয় তিনি তাঁর মত পালটাতেন।
পরদিন খুব ভোরে বৈদ্যনাথ চলে গেল ওয়েলিংটন স্কোয়ারে ডাঃ রায়ের বাড়ি। সে জানতো, সকাল আটটার মধ্যেই ডাঃ রায় আজকাল রাইটার্স বিল্ডিং-এ চলে যান। ঘরে ঢোকবার অধিকার আজ আর তার নেই। এখন গেট-এ থাকে বন্দুকধারী সান্ত্রী, ছাড়পত্র ছাড়া তাকে ঢুকতে দেবেই বা কেন! বাড়ির দক্ষিণ দিকের যে গেটটায় পুলিস ভ্যান দাঁড়িয়ে থাকে এবং যে গেট দিয়ে ডাঃ রায় বাড়ি থেকে বেরোন সেই গেট-এর উল্টোদিকের ফুটপাথে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল বৈদ্যনাথ।
আটটা বাজবার একটু আগেই ডাঃ রায়ের গাড়ি গেট-এর সামনে দাঁড়াল। মিনিট দশ বাদেই ডাঃ রায় বেরিয়ে এসে গাড়িতে ঢুকে বসলেন। বৈদ্যনাথের মনে হল গাড়িতে বসে ডাঃ রায় তার দিকে একবার বিস্ময়-ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিলেন। গাড়ি চলে গেল।
বৈদ্যনাথ তার কর্তব্য স্থির করে ফেলেছে। যতদিন না ডাঃ রায় ওর প্রতি প্ৰসন্ন মুখ তুলে তাকাচ্ছেন ততদিন রোজ সকাল আটটায় সে বাড়ির দক্ষিণ গেট-এর উল্টো ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকবে। দ্বিতীয় দিনেও একই অবস্থা, তৃতীয় দিনেও তাই। ডাঃ রায় বৈদ্যনাথকে দেখেও যেন দেখতে পাননি।
চতুর্থ দিন সকাল সাড়ে সাতটায় ফুটপাথে সবে এসে দাঁড়িয়েছে, সামনের পুলিস ভ্যান থেকে এক বন্দুকধারী সেপাই এসে বললে—‘বাবুজী, কয়ী রোজ সে দেখতা হুঁ আপ ইসি বখ্ত্, ইধর খাড়ে রহ্তে হেঁ। আপকা মতলব?’
বৈদ্যনাথ ম্লান হেসে বললে—‘মতলব কিছু নেই সিপাহীজী, স্রিফ দর্শনকে লিয়ে।’
সেপাই মাথা দুলিয়ে বললে—‘হ্যাঁ, ওহ্, তো সহী বাত। তব ঠিক হ্যায়।’
আটটা বাজবার একটু পরেই ডাঃ রায় বেরিয়ে এলেন। অপর দিকের ফুটপাথে বৈদ্যনাথকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আজ আর উপেক্ষা করতে পারলেন না। তাছাড়া এই ক’মাসে বৈদ্যনাথের চেহারার যে হাল হয়েছে তা দেখে ডাঃ রায়ের মনেও বোধহয় আশংকা দেখা দিয়েছিল যে, আবার একটা শক্ত অসুখে পড়তে পারে।