বিজয়িনী রাজ্যপালের দুই চোখ খুশিতে উজ্জ্বল।
একদিন এই খুশিই দেখা গিয়েছিল আমাদের রাজ্যপালের জননী স্বৰ্গতা সরোজিনী নাইডুর চোখে মুখে। তবে বিজয়ের গর্বে নয়, পরাজয়ের গৌরবে।
এলাহাবাদের ‘আনন্দ ভবনে’ অন্তরঙ্গদের আসর বসেছে। উপস্থিতদের মধ্যে আছেন গান্ধীজী, ডাঃ আনসারী, বিধানচন্দ্র এবং সরোজিনী নাইডু।
হঠাৎ সরোজিনী দেবী বলে উঠলেন—‘ডাঃ রায়, বয়স তো আপনার পঞ্চাশে পৌছল। কিন্তু কী আশ্চর্য, এখনও দেখছি হাসলে আপনার গালে টোল পড়ে।’
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন ডাঃ রায়—
‘আর আপনি তো জানি পঞ্চাশ পেরিয়ে গিয়েছেন, কিন্তু কী আশ্চর্য, এ-সব আপনার নজর এড়ায় না!’
গান্ধীজী সেদিন হো হো শব্দে হেসে উঠেছিলেন।
এই ছোট্টো কৌতুককর ঘটনাটি পড়বার পরই মনে পড়ে গেল দূর অতীতের আর এক কাহিনী। সেদিনও মহাত্মা গান্ধী বিধানচন্দ্রের কথায় এই ভাবেই সশব্দে হেসে উঠেছিলেন।
গান্ধীজীর সঙ্গে বিধানচন্দ্রের প্রথম পরিচয় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর তাঁর ভবানীপুরের বাড়িতে। তার আগে গান্ধীজীকে আরও দুবার তিনি দেখেছেন। একবার ১৯২৫ সালে মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর বাসভবনে, আর একবার, তার পাঁচ বছর পরে, ওয়েলিংটন স্কোয়ারে কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে। কিন্তু সাক্ষাৎ পরিচয় সেই প্রথম। আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন বাসন্তী দেবী। সেইদিন থেকেই বিধানচন্দ্র মহাত্মা গান্ধীর একজন একনিষ্ঠ অনুরক্ত শিষ্য হয়ে গেলেন। যখনই যেখানে গান্ধীজীর অসুস্থতার সংবাদ পেতেন সেখানেই তাঁর শয্যাপার্শ্বে উপস্থিত ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়।
আগস্ট আন্দোলনের পরের কথা। গান্ধীজী তখন পুণায় আগা খাঁর গৃহে বন্দী। ক’দিন আগে সবে তিনি তাঁর একুশ দিনের অনশনব্রত ভঙ্গ করেছেন। ডাঃ রায় সেবারেও তাঁকে দেখে গিয়েছেন। এবার নিজের কাজেই তিনি বোম্বাই এসেছিলেন, ভাবলেন একবার মহাত্মার সঙ্গে দেখা করে যাই।
কিন্তু বিধানচন্দ্রকে দেখে গান্ধীজী খুশি হলেও তাঁর চিকিৎসার প্রস্তাব শুনে মোটেই খুশি হলেন না। বললেন—
‘ডাক্তার, তোমার চিকিৎসা তো আমি নিতে পারি না।’
—‘আমার অপরাধ?’ জানতে চাইলেন বিস্মিত বিধানচন্দ্র।
‘আমার দেশের চল্লিশ কোটি দীন-দুঃখীর অসুখে যখন চিকিৎসা করতে পার না, তখন আমিই বা তোমার চিকিৎসা কেন নেব?’ সহজ সরল বিশ্বাস নিয়েই উত্তর দিলেন গান্ধীজী।
ডাঃ রায় বললেন—‘ও, এই কথা! আমি চল্লিশ কোটি নরনারীর চিকিৎসা করতে পারি না সত্য—কিন্তু এই চল্লিশ কোটি মানুষের আশা-ভরসা যিনি, যিনি বাঁচলে চল্লিশ কোটি বাঁচবে—তাঁর চিকিৎসার ভার তারাই আমার হাতে তুলে দিয়েছে। সুতরাং আপনি আপত্তি করলেও আমি তা মানব কেন?’
গান্ধীজীর মুখে এবার কৌতুকের হাসি দেখা দিল। তিনি বললেন—
‘আচ্ছা, তা না হয় হল। কিন্তু ডাক্তার, তোমার অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা আমি মেনে নিতে পারি না।’
তৎক্ষণাৎ ডাঃ রায় বললেন—‘মহাত্মাজী, আপনিই না বলেন পৃথিবীর সব কিছু, এমন কি ধূলিকণাটি পর্যন্ত ঈশ্বরের সৃষ্টি।’
‘নিশ্চয়; এবং অন্তরের সঙ্গে এ-কথা আমি বিশ্বাস করি।’ দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দিলেন গান্ধীজী।
এবারে বিধানচন্দ্রের পাল্টা জবাবের পালা। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বললেন—
‘তাহলে মহাত্মাজী, অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসাও কি তাঁর সৃষ্টি নয়?’
এবার মহাত্মাজী হেসে বললেন—‘তোমার উকিল-ব্যারিস্টার হওয়া উচিত ছিল ডাক্তার।’
সপ্রতিভ ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় বললেন—‘ভগবান তা না করে আমাকে চিকিৎসক করেছেন, কারণ তিনি জানতেন, এমন একদিন আসবে যেদিন তাঁর সেরা ভক্ত মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর চিকিৎসার ভার আমার উপর পড়বে।’
হো হো শব্দে হেসে উঠলেন গান্ধীজী। বিধানচন্দ্রকে সস্নেহে কাছে টেনে নিয়ে বললেন—‘তোমার সঙ্গে পেরে ওঠা দায়। কি ওষুধ দেবে দাও, খাই।’
কখন বেলা দশটা বেজে গিয়েছে টের পাইনি। আমার বাড়ির ছোকরা চাকর কালিদাস বললে—‘দাদাবাবু, আপনার কি বেরোতে দেরী হবে?’
‘কেন বল তো?’
সঙ্কোচের সঙ্গে কালিদাস বললে—‘আপনার যদি আপিসে বেরোতে দেরী থাকে আমি তাহলে ছুটে গিয়ে একবার ডাক্তারবাবুকে দেখে আসতাম। কোনোদিন তাঁকে দেখি নাই।’
অবাক বিস্ময়ে কালিদাসের মুখের দিকে তাকালাম। চব্বিশ পরগণার এক অজ পাড়াগাঁয়ের ছেলে কালিদাস। কলকাতা শহরে প্রথম এসে আমার বাড়িতেই কাজে লেগেছে আজ সাত-আট মাস হল। শহরের সে কিছুই জানে না, চেনে না। ডাঃ রায় কে ছিলেন, কিছুই তার জানবার কথা নয়। তবু তার দিকে তাকিয়ে মনে হল সে-ও যেন তার আপনজনকে হারিয়েছে! তার বিষণ্ণ মুখ আর ব্যথাতুর দৃষ্টি সেই স্বাক্ষর বহন করছে।
‘আমার আপিসের জামাকাপড় গুছিয়ে দিয়ে তুই চলে যা। আমি পরেই বেরোবো।’
সম্মতি পেয়ে তাড়াহুড়ো ক’রে কাজ সেরেই কালিদাস ঝড়ের মতো বেরিয়ে গেল।
সংবাদপত্রে ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের কর্মময় জীবনের কত আলেখ্য, কত ঘটনা, কত কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে—যার অনেক কিছুই সাধারণ মানুষের অজানা। প্রচারবিমুখ এই মানুষটি মুখ্যমন্ত্রী হবার আগে পর্যন্ত নিজেকে সর্বদাই নেপথ্যে রেখেছিলেন। এতকাল তাই চিকিৎসাবিদ্রূপে তাঁর বিপুল সাফল্যই লোকে জেনেছে, তাঁর জীবনের কঠোর সংগ্রামের কথা অনেকেরই জানা ছিল না।
১৯০৪ সালের কথা। বিধানচন্দ্র তখন মেডিকেল কলেজে সবে ভর্তি হয়েছেন। সেবার ছুটিতে ওঁরা কয় বন্ধু মিলে বেড়াতে গিয়েছেন বর্ধমানে। ফেরার পথে ট্রেনে উঠতে গিয়ে দেখেন ইন্টার ক্লাস কামরায় যাত্রীরা সব দাঁড়িয়ে। কী ব্যাপার? এ সময়ে তো ভিড় হবার কথা নয়। ওঁরা দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলেন। ঢুকে দেখেন ভিড়ের কারণ এক অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান দম্পতি। স্বামী-স্ত্রী দুজনে দুটি বেঞ্চ দখল করে বসে আছেন, অন্যরা বসতে গেলেই অকথ্য কুকথ্য ভাষায় গালিগালাজ। তখন রেল কোম্পানিতে ছিল অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ানদের রাজত্ব, দাপটও ছিল প্রচণ্ড। বিধানচন্দ্র ও তাঁর বন্ধুরা ব্যাপার দেখে স্তম্ভিত। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুদের মধ্যে ইশারা হয়ে গেল। বসে পড়লেন সাহেব আর মেমসাহেবের পাশে। বলা বাহুল্য সাহেব আপত্তি জানালেন, কিন্তু বিধানচন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে মেডিকেল কলেজের সেই ছাত্রদের কাছে সাহেবকে পরাজয় স্বীকার করতেই হল। সবাইকে বসবার জায়গা দিতে বাধ্য হলেন। পরবর্তী জীবনে সেদিনের ঘটনা স্মরণ করে বিধানচন্দ্র বলতেন—সেদিন আমাদের কী আনন্দ, আমরা যেন ইংরেজ প্রভুদেরই হারিয়ে ফিরছি।