ম্যানেজার বললেন—‘সরি, আমাদের দফতরে তোমার কোনো চিঠি এসে পৌঁছয়নি।’
বৈদ্যনাথের আর বুঝতে দেরী হল না যে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে জোট পাকিয়ে, এই চার্জ-শীট আনা হয়েছে এবং করনক্ সাহেবই এর মূলে।
বৈদ্যনাথের মাথায় তখন রক্ত চড়ে গেছে। একবার মনে করল সটান বড় সাহেবের কাছে গিয়ে সে কৈফিয়ৎ চাইবে। পরক্ষণেই তার অভিমানে ঘা লাগল। চার্জ শীট-এ বড় সাহেব যখন সই করেছেন তখন বিশ্বস্ততার কোনো মূল্যই এদের কাছে নেই। এ আপিসে আর একদিনও তার পক্ষে চাকরি করা সম্ভব নয়, তা সে আগেই বুঝে গিয়েছিল। তবু চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে যাবার আগে করনকের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করে নিতে হবে!
ম্যানেজারের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ঝড়ের বেগে সুইং ডোর খুলে করনকের ঘরে ঢুকেই বৈদ্যনাথ ফেটে পড়ল। বৈদ্যনাথের চোখে মুখে একটা হিংস্র মারমূর্তি ভাব। চাপা আক্রোশপূর্ণ কণ্ঠে বৈদ্যনাথ বললে—‘আমার নামে মিথ্যা চার্জ—শীট দিয়েছ কেন?’
করনক্ নির্বিকার কণ্ঠে উত্তর দিল—‘আমি কি জানি। আস্ক দি ম্যানেজার।’
‘কিন্তু আমি জানি, তোমার ইন্ষ্টিগেশনেই এটা করা হয়েছে।’
করনক্ আবার মোলায়েম কণ্ঠে বললে—‘বিকজ ইউ আর গিল্টি।’
টেবিলের উপর প্রচণ্ড ঘুষি মেরে চীৎকার করে উঠল বৈদ্যনাথ— ‘হোয়াট? চুরি করবে তোমরা আর সেই চোর ধরিয়ে দেবার জন্যে গিলটি হলাম আমি?’
করনক্ প্রথমে ঘাবড়ে গেল বৈদ্যনাথের মারমূর্তি দেখে। ওদিকে চীৎকার শুনে আপিসের বয়, বেয়ারা ও অন্যান্য কেরানীরা ছুটে এসেছে। করনক্ তখন বীরত্ব দেখাবার জন্য গর্জন করে উঠল—‘গেট আউট ফ্রম মাই রুম ইউ সোয়াইন। ডাঃ রায়ের লোক বলে তুমি যে আমাদের উপর চোখ রাঙাবে তা চলবে না।’
বৈদ্যনাথ বললে—‘ডাঃ রায়ের নাম উচ্চারণ করেছো তো তোমার জিভ ছিঁড়ে ফেলে দেব।’
করনক্ মুখটা যতদূর সম্ভব বিকৃত করে বললে—‘রেখে দাও তোমার ডাক্তার রায়।’ এই বলেই করনক্ এমন কতগুলি কথা বলল যে বৈদ্যনাথ দিগ্বিদিক্ জ্ঞানশূন্য হয়ে এক কাণ্ড করে বসল। পোর্টফোলিও ব্যাগ ছিল ওর হাতে। সেটা খুলেই খোপ থেকে একটা পিস্তল ক্ষিপ্রবেগে বের করেই করনকের কপাল লক্ষ করে একেবারে খাস চাঁদপুরী জবানীতে চীৎকার করে বলল—‘আইজ তরে শ্যাশ করুম কুত্তার বাচ্চা। তরে আইজ আমি মাইরাই ফালামু।’
করনক্ এক লাফে ঘর থেকে বেরিয়েই হন্তদন্ত হয়ে ছুটতে ছুটতে চেঁচাচ্ছে, ‘হেল্প, হেল্প।’
পিছনে পিস্তল নিয়ে তাড়া করেছে বৈদ্যনাথ, মুখে এক কথা—‘তরে আইজ মাইরাই ফালামু।’
অফিসের যে বেয়ারাগুলি প্রথমে এ-দৃশ্য দেখে হক্চকিয়ে গিয়েছিল, পরমুহূর্তেই তারা একজোটে ঝাঁপিয়ে পড়ল বৈদ্যনাথের উপর। ওদিকে সঙ্গে সঙ্গে লালবাজারে ফোন করে দেওয়া হয়েছে, পুলিস এসে পিস্তলসহ বৈদ্যনাথকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল।
॥ নয় ॥
পুলিস অফিসার বারবার করে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে লাগল বৈদ্যনাথকে, কোনো উত্তর নেই। অনেক ধমক, অনেক ভয় দেখানো হল, বৈদ্যনাথ বোবা হয়ে বসে আছে। শুধু বললে—‘আপনার টেবিলের টেলিফোনটি একবার ব্যবহার করতে দেবেন?’
অফিসার বললে—‘আপনার গুণ্ডার দলকে খবর দিতে চান তো? ওসব এখন হবে না! আজকের দিনটা তো লক-আপে থাকুন, পিস্তল কোথায় পেয়েছেন স্বীকার না করলে বেশ ভাল রকম কম্বল-ধোলাই হোক, তারপর দলবলকে খবর দেওয়া। তাছাড়া কাল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করার পর বেইল নেবার প্রশ্ন।’
অনেকক্ষণ ধরে বৈদ্যনাথকে অকথ্য-কুকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে পুলিস অফিসার ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। একটু বিশ্রাম নেবার জন্য টেবিলের উপর পা দুটো তুলে চেয়ারে হেলান দিয়ে মনের সুখে ধোঁয়া ছাড়ছিলেন। এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল। রিসিভারটা তুলে নিলেন।
‘হ্যালো!’
ওদিক থেকে কী একটা কথা হতেই স্প্রিং দেওয়া পুতুলের মতো অফিসার চেয়ারে খাড়া হয়ে বসলেন আর বলতে লাগলেন—‘হ্যাঁ স্যার, এখানেই আছে স্যার, ভালই আছে স্যার, এক্ষুনি নিয়ে যাচ্ছি স্যার, দশ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাচ্ছি স্যার, ও কিছু ভাববেন না স্যার।’
টেলিফোনটা রেখেই বিস্ময়ে বিস্ফারিত চোখে পুলিস অফিসার বললেন —‘ওরে বাবা! আপনি যে দেখছি খোদ কর্তার লোক! উঠুন, এক্ষুনি দশ মিনিটের মধ্যে আপনাকে খোদ কর্তার কাছে হাজির করতে হবে।’
পুলিস অফিসার রুমাল বার করে ভালো করে কপালের ঘাম মুছলেন, টেবিল থেকে হ্যাটটা মাথায় দিতে দিতে বললেন—‘গোড়াতে বললেই হত, মিছিমিছি আপনার উপর এত চোটপাট করলাম।’
বৈদ্যনাথ বললে—‘আপনি আমাকে টেলিফোন করতে দিলেন কোথায়!’
‘যাক, যা হবার হয়ে গেছে। আপনি মশাই দয়া করে কর্তার কাছে আমাদের বিরুদ্ধে আবার নালিশ করবেন না।’
বৈদ্যনাথ ঠিকই অনুমান করেছিল যে ডাঃ রায়ের কাছ থেকে তলব এসেছে। ওষুধ কোম্পানির বড় সাহেব নিশ্চয় টেলিফোন করে ডাঃ রায়কে খবরটা দিয়েছে। বৈদ্যনাথ অফিসারকে বললে—‘আপনাদের বিরুদ্ধে আমার কি বলবার থাকতে পারে, আপনারা আপনাদের কর্তব্যই করেছেন!’
রাইটার্স বিল্ডিং-এ ডাঃ রায়ের ঘরে পুলিস অফিসারের সঙ্গে ঢুকল বৈদ্যনাথ। ডাঃ রায় নিবিষ্ট মনে একটা চিঠি পড়ে ডিকটেশন দিচ্ছিলেন স্টেনোকে। থেমে গেলেন। বৈদ্যনাথের দিকে একবার তীক্ষ্ম দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নিলেন। স্টেনোকে বললেন চলে যেতে, বললেন পুলিশ অফিসারকেও। পুলিস অফিসার স্যালুট দিয়ে বিদায় নিতেই ডাঃ রায় বজ্রগম্ভীর গলায় বললেন—‘তুমি আমার নাম ডুবিয়েছ বৈদ্যনাথ, আমার মুখে চুনকালি দিয়েছ। আমি ধারণাই করতে পারিনি তুমি এমন জঘন্য কাজ করবে।’