ডাঃ রায় সব শুনে বললেন—‘তোমার মা যখন কথা দিয়েছেন, যতই কাজ থাক, আমাকে যেতেই হবে। আজই বিকেলে যাব, পাঁচটার সময় এসে আমাকে নিয়ে যেয়ো। যে-ডাক্তার এতদিন ওঁর চিকিৎসা করছিলেন তাঁকে থাকবার জন্যে একটা খবর পাঠিয়ে দাও।’
বিকেল বেলা বৈদ্যনাথ এসে ডাক্তার রায়কে নিয়ে গেল বেলেঘাটায় রুগীর বাড়ি। ভাল করে পরীক্ষা করে ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করে দিয়ে যে-ডাক্তার দেখছিলেন তাঁকে বললেন—‘বৈদ্যনাথকে দিয়ে খবর পাঠাবে রুগী কেমন থাকে না থাকে।’
রুগীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠবার সময় বৈদ্যনাথ বলল— ‘স্যার, আমার বাড়ি তো এই পাড়ায়, বেশী দূর নয়। যদি একবার আসেন—’
বৈদ্যনাথের পিঠে মৃদু চাপড় দিয়ে ডাঃ রায় বললেন—‘হবে হবে। এ-বাড়িতে নয়, তুমি যখন নিজে বাড়ি করবে তখন সেই বাড়িতে যাব।’
কথাটা বৈদ্যনাথের মনের মধ্যে গেঁথে গেল। কঠিন সংকল্প সে করল, ডাঃ রায়কে ওর বাড়িতে একদিন আনতেই হবে। ইতিমধ্যে ভবানীপুরে একটা ফ্ল্যাট পেয়ে গেল বৈদ্যনাথ। দু’খানা ঘর, ভাড়া চল্লিশ টাকা।
কয়েক বছরের মধ্যেই দেশের চেহারা গেল পালটে। ভারতবর্ষ স্বাধীনতা অর্জন করেছে, বাংলাদেশ দ্বিখণ্ডিত। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় এখন পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী। সকাল বেলা আর বৈদ্যনাথের ডাঃ রায়ের বাড়ি যাবার প্রয়োজন হয় না, একমাত্ৰ ছুটির দিন ছাড়া। ভবানীপুরের ফ্ল্যাটের চেহারা বদলেছে। দুই ঘরে পাখা এসেছে, রেডিও-সেট এসেছে, নিয়ন বাতি জ্বলছে। স্ত্রীর গায়ে সোনার গয়নাও উঠেছে। বৈদ্যনাথ এখন দুটি সন্তানের পিতা। ইতিমধ্যে এক কাণ্ড ঘটে গেল।
বালীগঞ্জ সার্কুলার রোডে সাহেব-পাড়ায় কোম্পানির যে ওষুধের দোকান আছে, সেখানে হিসেবের প্রচুর গলদ ধরা পড়েছে। বড় সাহেব বৈদ্যনাথকে ভার দিলেন সে-দোকানের সব স্টক আর পুরোনো ক্যাশ মেমো ভালো করে পরীক্ষা করে দেখতে। রাত আটটায় দোকান বন্ধ হয়ে গেলে বৈদ্যনাথের কাজ শুরু হয়, রাত দশটা এগারোটা পর্যন্ত পুরোনো কাগজপত্র ঘেঁটে পরীক্ষা করে, অবশেষে নির্জন রাস্তা দিয়ে হেঁটে সে বাড়ি ফেরে। পুরোনো কাগজপত্র দেখতে দেখতে বেরিয়ে পড়ল করনক্ সাহেবের চোরাকারবারের মোক্ষম প্রমাণ। হেড আপিসের নির্দেশে কারখানা থেকে যে-মাল দোকানে এসেছে তার কোনো নির্দেশ হেড আপিসের খাতায় নেই, দোকানের খাতায়ও তার এনট্রি নেই। অথচ কারখানার চালানে দেখা যাচ্ছে হেড আপিসের খাতায় যে-মাল এই দোকানে ডেলিভারি দেওয়া হয়েছে বলে এনট্রি করা আছে তার চারগুণ মাল প্রতি মাসে এই দোকানে এসেছে, অথচ খাতাপত্রে দেখানো হয়েছে যে স্টকে যা মাল ছিল তা খালি হয়নি বলেই মাল পাঠানো হচ্ছে না। এক দোকানের এই গরমিল ধরা পড়তেই ভবানীপুর ও শ্যামবাজারের দোকানে খোঁজ নিয়েও বৈদ্যনাথ দেখল সেখানেও ঐ একই ব্যাপার।
আর কালক্ষেপ না করে বৈদ্যনাথ নথিপত্রের প্রমাণসহ এক গোপন রিপোর্ট সরাসরি পাঠিয়ে দিল ম্যানেজিং ডিরেক্টরের কাছে। কিছুদিনের মধ্যেই তোলপাড় হয়ে গেল হেড আপিসে। করনক্ সাহেব ডি-গ্রেডেড হলেন—শুধু তাই নয়, অনুকম্পাবশত বড় সাহেব তাকে পুলিসে ধরিয়ে দেননি বটে, বহু টাকার খেসারৎ দাবী করলেন এবং করনক্ সাহেব আর বড়বাবুকে খেসারতের টাকা দিতেও হল। করনক্ সাহেব টের পেয়েছিলেন যে এ-কাজটা বৈদ্যনাথ ছাড়া আর কারুর নয়। রাগে গজরাতে লাগলেন তিনি, সুযোগ পেলে প্রতিশোধ না নিয়ে ছাড়বেন না।
সুযোগ পেয়েও গেলেন। চাঁদপুর থেকে বৈদ্যনাথের মামা তার কাছে চিঠি লিখে জানিয়েছেন, প্রাণ আর সম্মান নিয়ে ওদেশে এখন আর বাস করা অসম্ভব। আতঙ্কে দিনেরাত্রে ওদের চোখে ঘুম নেই। চিঠি পেয়েই মা কেঁদে পড়লেন বৈদ্যনাথের কাছে।
‘একবার যা বৈদ্যনাথ, দেখে আয় ওরা কী অবস্থায় আছে। হাজার হোক আপন মামা, এই বিপদে তুই ছাড়া ওদের আর দেখবার কে আছে!
মায়ের অনুরোধ, এড়ানো কঠিন বড়। দশ দিনের ছুটি নিয়ে চলে গেল বৈদ্যনাথ প্রথমে ঢাকায়। ডা: রায়ের দৌলতে সুরাবর্দী সাহেব ও ফজলুল হকের সঙ্গে পরিচয় ছিল বৈদ্যনাথের। দুজনের কাছ থেকেই চিঠিপত্র নিয়ে চাঁদপুরে এসে এস ডি ও-র সঙ্গে দেখা করল। এস ডি ও প্রচুর খাতির সম্মান করলেন বৈদ্যনাথকে। এমন কি নিজে বৈদ্যনাথের মামার সঙ্গে দেখা করে অভয় দিয়ে বললেন যে, ওঁরা নিশ্চিন্ত হয়ে চাঁদপুরে থাকতে পারেন। গায়ে আঁচড়টি পর্যন্ত লাগতে দেবেন না। এই সব বন্দোবস্ত করে কলকাতায় ফিরতে দশ দিনের জায়গায় হয়ে গেল বাইশ দিন। ইত্যবসরে করনক্ নতুন সেলস্ ম্যানেজারকে হাত করে ফেলেছে, তাকে বুঝিয়েছে বৈদ্যনাথকে এ আপিস থেকে না তাড়াতে পারলে নেটিভের হাতে ওদের পদে পদে অপমান সহ্য করতে হবে।
চাঁদপুর থেকে ফিরে এসে প্রথম সে গেল হেড আপিসে। সেখানে গিয়েই সে শুনতে পেল তার নামে নাকি চার্জ—শীট আনা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে—সে কাজে ফাঁকি দেয়, উপরন্তু উইদাউট নোটিশ সে বারো দিন আপিস কামাই করেছে। বৈদ্যনাথ সঙ্গে সঙ্গে বুঝে নিল যে এটা করনকের কীর্তি। খবরটা শুনে সে প্রথমে সেলস্ ম্যানেজারের ঘরে যেতেই তিনি বড় সাহেবের সই-করা চার্জশীট তার হাতে তুলে দিলেন। রাগে ক্ষোভে দুঃখে বৈদ্যনাথের হাত-পা ঠক ঠক করে কাঁপছে। বললে—‘চাঁদপুর থেকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলাম যে আমার ফিরতে দিন দশ-বারো দেরী হতে পারে।’