ইতিমধ্যে বৈদ্যনাথ বেলেঘাটা অঞ্চলে দু’ঘরওয়ালা একটা বাড়ি ভাড়া নিয়েছে পঁচিশ টাকা দিয়ে। ডাঃ রায় আরো পাঁচ টাকা মাইনে বাড়িয়ে ত্রিশ টাকা করেছেন, ওষুধের কোম্পানীর কাজে মাইনে পায় ষাট টাকা, সেই সঙ্গে অল সেকশন ট্রামের টিকিট। সুতরাং বৈদ্যনাথের আর কোনো অভাব-অভিযোগ নেই, এবার মাকে সে কলকাতায় স্বচ্ছন্দে এনে রাখতে পারে। মা’র কাছে যখনই বৈদ্যনাথ এ প্রস্তাব পাঠায় মা চিঠির উত্তরে জানান বৈদ্যনাথকে একবার দেশে যেতে। অনেক বছর দেখেননি, ছেলেকে দেখবার তো সাধ যায়। মামার এখন মায়ের প্রতি খুব সদয়। মাসে মাসে টাকা যাচ্ছে, সে টাকার বেশির ভাগই মা তাঁর ভাইদের হাতে তুলে দেন। সুতরাং শহরের ডামাডোলে মাকে ওঁরা একা থাকতে দিতে চান না। ছেলে তো সকাল থেকে রাত্রি চাকরি করবে। মা সারাদিন একা বাড়িতে পড়ে থাকবে, সে হতেই পারে না। বৈদ্যনাথের মামা শুনেছে কলকাতায় চোরেরা দিনদুপুরে বাড়িতে ঢুকে লোক খুন করে পালিয়ে যায়।
একদিন সকালে ডাঃ রায় বৈদ্যনাথকে বললেন—‘কী হে, তুমি না বলেছিলে মাকে কলকাতায় নিয়ে আসবে, তার কি হল?’
বৈদ্যনাথ মাথা চুলকে কাঁচুমাচু হয়ে বললে—‘মা তো এখন কিছুতেই আসতে চাইছেন না, উল্টে এক ফ্যাসাদ বাঁধিয়ে বসেছেন।’
‘ফ্যাসাদ আবার কী। কলকাতায় বাড়ি ভাড়া করেছো, ভাল চাকরি করছে—এর মধ্যে ফ্যাসাদটা কোথায়।’
খুবই সঙ্কোচের সঙ্গে সলজ্জ বৈদ্যনাথ বললে—‘মা বারবার লিখছেন সামনের বৈশাখ মাসে একবার দেশে যেতে। মা’র বয়েস হয়েছে, একা-একা আর ভাল লাগছে না। একটি পাত্রী দেখেছেন, পছন্দও হয়েছে খুব। আমাদের জানাশোনা ঘরের মেয়ে।’
উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠলেন ডাঃ রায়। বললেন—‘তাই তো হে, তুমি যে এখন একজন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার উদ্ধারকারী উপযুক্ত পাত্র হয়ে উঠেছে, সেটা তো আমার খেয়াল ছিল না। খুবই ভাল কথা, তোমার মা ঠিক কথাই লিখেছেন। এই বয়সেই তো বিয়ে করা উচিত। তাহলে আর কালবিলম্ব না করে এক মাসের ছুটি নিয়ে চলে যাও।’
বৈদ্যনাথ চুপ করে দাঁড়িয়ে। ডাঃ রায় আত্মস্থ হয়ে কী যেন ভাবতে লাগলেন। হঠাৎ বলে উঠলেন—‘বিয়ে তো করতে যাচ্ছ, খরচ আছে তো। টাকাপয়সার কী ব্যবস্থা করেছে। তোমার কাছে বা তোমার মা’র কাছে কিছু থাকবার তো কথা নয়।’
বৈদ্যনাথ বললে—‘মাকে আমিও সে-কথা লিখেছিলাম এবং আরো কিছুদিন অপেক্ষা করার কথাও জানিয়েছিলাম। কিন্তু কন্যাপক্ষ আর অপেক্ষা করতে রাজী নন বলে মা ধারকর্জ করেই কাজটা বৈশাখ মাসেই চুকিয়ে ফেলতে চান।’
ডাঃ রায় অবাক হয়ে বৈদ্যনাথের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন—‘ধার-দেনা করে ছেলের বিয়ে দেবেন! এটা কোনো কাজের কথা হল?’
বৈদ্যনাথ উৎসাহিত হয়ে বললে—‘আপনি ঠিকই বলেছেন। আপনার কথা উল্লেখ করে মাকে লিখে দিই এ-সব হাঙ্গামা না করার জন্যে।’
বৈদ্যনাথের কথায় ডাঃ রায় কোনো সায় দিলেন না। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর বললেন—‘শ পাঁচেক টাকা হলে খরচপত্ৰ কুলিয়ে যাবে বলে কি তোমার মনে হয়?’
বৈদ্যনাথ বললে—‘আমার যদিও কোনো ধারণা নেই, তবে এ টাকায় কুলিয়ে যাওয়া তো উচিত।’
‘ঠিক আছে। তুমি আজই ছুটির দরখাস্ত করে দাও। দেশে যাবার সময় আমার কাছ থেকে পাঁচশ টাকা নিয়ে যেয়ে। এতে যদি কুলিয়ে যায় ভালো, না কুলোলে চিঠি লিখো, পাঠাব।’
॥ আট ॥
এক মাস ছুটির পর বৈদ্যনাথ বিয়ে করে একাই কলকাতা ফিরে এসেছে। চেহারা দেখে চেনবার উপায় নেই। তসরের পাঞ্জাবি তাতে সোনার বোতাম, হাতে হাতঘড়ি, আঙ্গুলে সোনার আংটি। এ বৈদ্যনাথ আরেক মনুষ।
ডাঃ রায়ের সঙ্গে দেখা করতেই বললেন—‘বুঝেছে। বৈদ্যনাথ, তোমার চেহারা আর সাজপোশাক দেখে এই বুড়ো বয়সে আমারো লোভ হচ্ছে। এই অপাত্রে কেউ পাত্রী দেবে না, এই যা দুঃখ। তা কেমন বউ হল বল। পছন্দ হয়েছে তো?’
বৈদ্যনাথ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল, মুখে সলজ্জ হাসি।
ডাঃ রায় হাসতে হাসতে বললেন—‘বুঝেছি, পছন্দ তা হলে হয়েছে। স্বাস্থ্য ভালো তো?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘মা খুশি হয়েছেন?’
‘মা খুবই খুশি।’
ডাঃ রায় মৃদু হেসে বললেন—‘এবার মাকে আর বউমাকে কলকাতায় নিজের কাছে এনে রাখো।’
পুজোর সময় ক’দিনের ছুটিতে দেশে গিয়ে বৈদ্যনাথ মা ও স্ত্রীকে কলকাতায় এনে তুলল বেলেঘাটার বাড়িতে। এখন আর বৈদ্যনাথকে ডালহৌসির হেড অফিসে যেতে হয় না, শহরের বিভিন্ন অঞ্চলের দোকানে ঘুরে ঘুরে ওষুধের স্টক মিলিয়ে রিপোর্ট দেওয়াই একমাত্র কাজ। এই কাজ করতে করতেই ও টের পেয়েছিল যে করনক্ সাহেব বড়বাবুর সঙ্গে যোগ-সাজসে এক বিরাট চুরির জাল বিস্তার করে কোম্পানিকে ফোঁপরা করে এনেছে, কিন্তু হাতেনাতে ধরা পড়ার মতো কোনো নজির কোথাও রাখেনি। ইতিমধ্যে বৈদ্যনাথের মাইনে আরো কুড়ি টাকা বেড়ে আশী হয়েছে, এখন ওর বেশ স্বচ্ছল অবস্থা। অল সেকশন ট্রামের টিকিট, যখন খুশি যেখানে খুশি ঘুরে বেড়ায়, সময়ে অসময়ে বিভিন্ন দোকানে গিয়ে স্টক চেক করে। চুরির আঁচ পেলেও বড় প্রমাণ পাচ্ছে না বলে করনক্ সাহেবকে ও ঘাঁটায় না, তক্কে তক্কে আছে।
ডাঃ রায় তখন একজন সর্বশ্রেষ্ঠ ডাক্তারই শুধু নন, আজ তিনি সর্ব-ভারতীয় নেতা। প্রতিদিন সকালে বৈদ্যনাথ ডাঃ রায়ের বাড়ি যায়, কিন্তু কথা বলার ফুরসত বড় একটা হয় না। এদিকে বেলেঘাটায় যে পাড়ায় বৈদ্যনাথ থাকে সেখানে ওর খাতির সম্মান বেড়ে গেছে, যেহেতু সে ডাঃ রায়ের প্রিয়পাত্র। তাঁর বাড়িতে ওর নিত্য যাওয়া-আসা এ-খবরটা পাড়ার ছেলেছোকরা থেকে মাতব্বরদেরও জানা হয়ে গিয়েছে। পাড়ার পুরোনো বাসিন্দা অঘোরবাবু কঠিন অসুখে তিন মাস শয্যাশায়ী। অত্যন্ত গরিব। বড় ডাক্তার ডেকে দেখাবার সামর্থ্য নেই, ধরপাকড়ের মাতব্বরেরও অভাব। পাড়ার ডাক্তার হাল ছেড়ে দিয়ে বলে গেল, বৈদ্যনাথবাবুকে ধরে একবার ডাঃ রায়কে দেখান। অঘোরবাবুর স্ত্রী বৈদ্যনাথের মা’র কাছে কেঁদে পড়ল। বৈদ্যনাথ আজ পর্যন্ত এসব ব্যাপারে ডাঃ রায়কে কখনো কোনোদিন অনুরোধ করেনি, কিন্তু মায়ের পীড়াপীড়িতে ডাঃ রায়কে সে-কথা বলতে বাধ্য হল।