উল্লসিত হয়ে সাহেব বললেন—‘দ্যাট্স্ ফাইন, আমি এখুনি বলে দিচ্ছি।’
ঠং করে টেবিলের ঘণ্টা বেজে উঠতেই বেয়ারা এসে হাজির। সাহেব বললেন—‘সেলস্ ম্যানেজার মিঃ করনক্ কো সেলাম দেও।’
একটু পরেই মাঝবয়েসী গোলগাল চেহারার এক সাহেব এসে কামরায় ঢুকে মাথাটা একটু নত করে বললে—‘গুড মনিং স্যার।’
সাহেব মুখ না তুলেই বললেন—‘মর্নিং, তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি— মীট মিস্টার বি বোস, ডক্টর রয়জ্, ক্যাণ্ডিডেট। স্পোক হাইলি অব হিম। সেলস্ ডিপার্টমেন্ট-এ ফীল্ড ওয়র্কের কাজ করবে। আ’ইল ফিক্স আপ হিজ স্যালারি লেটার অন।’
বৈদ্যনাথকে গুডলাক আর গুডউইস জানিয়ে সাহেব বললেন—‘ইফ ইউ উইশ, কাল থেকেই তুমি কাজে লেগে যেতে পার।’
ধন্যবাদের সঙ্গে সাহেবের কথায় সম্মতি জানিয়ে বৈদ্যনাথ সেলস্ ম্যানেজারের পিছন পিছন কামরা থেকে বেরিয়ে এল। সেলস্ ম্যানেজার মিঃ করনক্ যে একজন অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান, বৈদ্যনাথের তা বুঝতে দেরী হয়নি। চেহারা এবং ইংরিজি উচ্চারণের ধরনই তার পরিচায়ক। করনক্ সাহেব সঙ্গে করে ডিপার্টমেন্ট-এ নিয়ে গেলেন, কিন্তু তাঁর মুখে চোখে একটা বিরক্তির ভাব—এ আবার কোন্ আপদ এখানে এসে জুটল!
॥ সাত ॥
পরদিন সকাল থেকেই কাজে যোগ দেবে, সব ঠিক হয়ে গেল। প্রথম দু’মাস হেড অফিসে, তারপর থেকেই ব্রাঞ্চ শপগুলিতে ঘুরে ঘুরে কাজ করতে হবে। প্রথম কাজ স্টক মেলানো। কোন দোকানে কত ওষুধ
সাপ্লাই করা হয়েছে, স্টকে কত আছে এবং পরদিন আর কত সাপ্লাই করতে হবে তার হিসেব রাখা ও রিপোর্ট দেওয়া।
পরদিনই হাসপাতালের চাকরিটা বৈদ্যনাথ ছেড়ে দিল। যতদিন না বাসা ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে ততদিন হাসপাতালে থাকার অনুমতি সে সুপারিন্টেণ্ডেন্ট-এর কাছ থেকে চেয়ে নিল। সকালে যথারীতি ডাঃ রায়ের বাড়িতে বেলা ন’টা পর্যন্ত থেকে চলে গেল ডালহৌসী স্কোয়ারে। অফিসে যেতেই করনক্ সাহেব তাকে বসবার টেবিল-চেয়ার দেখিয়ে দিল, কাগজ- পত্র বুঝিয়ে দিল। মুখে সর্বদাই একটা গম্ভীর বিরক্তি ভাব।
এক ঘণ্টাও পার হয়নি, হঠাৎ বড় সাহেবের খাস বেয়ারা এসে বৈদ্যনাথকে সেলাম ঠুকে বললে—‘সাব আপকো বোলায়া।’
বৈদ্যনাথ তাড়াতাড়ি বড় সাহেবের ঘরে ঢুকতে তিনি বৈদ্যনাথের হাতে একটা টাইপ করা চিঠি দিয়ে বললেন—‘পড়ে দেখো।
অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। লেখা আছে, বেতন মাসে ষাট টাকা আর কনভেয়েন্স পনের টাকা। অর্থাৎ টাকার পরিবর্তে একটি অল সেকশন ট্রামের টিকিট। চিঠিটা পড়া শেষ হতেই সাহেব বললেন—‘ইজ ইট অলরাইট?’
সাহেবকে ধন্যবাদ জানিয়ে নিজের সীট-এ ফিরে এসে বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল বৈদ্যনাথ, ভাবতে লাগল তার ভাগ্য পরিবর্তনের কথা। একে একে অনেক সুখস্বপ্নই তার মনে উদয় হল। এবার সে কলকাতায় বাড়ি ভাড়া করবে। অপমান-জর্জর জীবন থেকে মাকে উদ্ধার করে নিজের কাছে এনে রাখবে। এসব স্বপ্নের মূলে রয়েছেন যিনি, সেই ডাক্তার রায়ের কথা বার বার মনে হতেই আবেগে তার দুই চোখ আপ্লুত হয়ে উঠছে।
হঠাৎ সেলস্ ম্যানেজার করনক্ বৈদ্যনাথকে ডেকে পাঠালেন। ঘরে ঢুকেই দেখে সাহেবের মুখ রাগী বুলডগের মতো খিঁচিয়ে আছে।
বৈদ্যনাথকে সে বললে—‘তোমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারের কপি এইমাত্র পেলাম। ডাঃ রায়ের লোক বলেই ম্যানেজিং ডিরেক্টর তোমাকে আশাতিরিক্ত মাইনে দিয়ে রেখেছেন। কারণ ডাঃ রায় হচ্ছেন আমাদের কোম্পানির একজন ডিরেক্টর। তোমাকে যে বেতন দেওয়া হয়েছে গ্রাজুয়েটরাও তা পায় না। তোমাকে একটা কথা বলে দিচ্ছি, ডাঃ রায়ের লোক বলে তুমি অ্যাডভানটেজ নেবার চেষ্টা কোরো না।’
বৈদ্যনাথ বেশ খানিকটা ঘাবড়ে গেল করনক্-এর কথা শুনে। আর এসব কথা চাকরির প্রথম দিনেই তাকে এমন চড়া মেজাজে বলার অর্থ কী?
বৈদ্যনাথের মেজাজ তখন একটু চড়েছে। গম্ভীর হয়ে বললে—‘আমার কাজে যদি আপনি সন্তুষ্ট না হতে পারেন, আমাকে ছাড়িয়ে দেবেন। ডাঃ রায়ের নাম এর সঙ্গে জড়াবেন না।’
অবাক হয়ে সাহেব বললে—‘ইজ দ্যাট সো! বেশ একটু শর্ট টেম্পারড মনে হচ্ছে।’ পরমুহূর্তেই রীতিমত ধমকে উঠলেন—‘যাও, নিজের সীট-এ বসে কাজ করে গে যাও। আমাদের কোম্পানির ওষুধের প্রাইস লিস্টটা সম্পূর্ণ মুখস্থ করতে হবে। পনেরো দিন বাদে আমি পরীক্ষা নেব।’
বৈদ্যনাথ নিজের জায়গায় চলে এল বেশ কিছুটা বিষন্ন মনেই। ওষুধের নাম-দাম ঠিকুজিকুষ্ঠি সব বৈদ্যনাথের আগেই জানা। হাসপাতালে এই কাজই করতে হয়েছে তিন বছর ধরে। সুতরাং করনক্ সাহেবের ওষুধের দাম মুখস্থর পরীক্ষা নেবার ধমকটা ওর কাছে হাস্যকর ব্যাপার। খারাপ লাগছিল ওর মনোভাব দেখে।
এই বিরুদ্ধ মনোভাবের কারণ খুঁজে পেতে বৈদ্যনাথের দেরী হল না। ডিপার্টমেন্ট-এর বড়বাবু হচ্ছে করনকের একান্ত অনুগত ও বশংবদ। যখনই নতুন লোক নেওয়া হয়েছে সে-লোক বড়বাবু সরবরাহ করেছেন করনকের সঙ্গে পরামর্শ করে, বড় সাহেব কোনোদিন আপত্তি করেননি। বৈদ্যনাথের বেলায় এই রীতির প্রথম ব্যতিক্রম, তার উপর সে ডাঃ রায়ের লোক।
সকালে বৈদ্যনাথ ডাঃ রায়ের বাড়ি যায়। চিঠিপত্র গুছিয়ে ফাইল করে রাখা বা সদ্য-আসা জার্নালগুলি সামনে রেখে পুরোনোগুলি অন্যত্র সরিয়ে রাখা ওর নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। মাঝে মাঝে ডাঃ রায়ের সঙ্গে দেখা হলেই জিজ্ঞাসা করেন—‘কী হে, চাকরিতে মন বসেছে তো?’