বৈদ্যনাথের কথা মনে পড়ে গেল ডাঃ রায়ের। খুশি হয়ে বললেন— ‘বেশ বেশ। ছেলেটির হাতের লেখা সুন্দর এবং পরিচ্ছন্ন। ওকে বোলো কাল সকালে আমার বাড়িতে গিয়ে দেখা করতে।’
পরদিন সকালে বেলা ন’টার একটু আগেই বৈদ্যনাথ ডাঃ রায়ের বাড়িতে হাজির। এবার আর ‘ছিলিপ লাগাও’-এর চেষ্টায় না গিয়ে গেটের সামনে অপেক্ষমান গাড়িটার পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। ঠিক ন’টায় ডাক্তার রায় গাড়িতে উঠতে যাবেন, বৈদ্যনাথ দুই হাত তুলে নমস্কার করে বলল—‘আমাকে ডেকেছিলেন স্যার?’
একটু বিরক্তির সঙ্গেই ডাক্তার রায় বললেন—‘হ্যা ডেকেছিলাম। কিন্তু এতক্ষণে তোমার দেখা করার সময় হল?’
‘আমি তো অনেক আগেই দেখা করতে পারতাম, কিন্তু—’
ডাঃ রায় বৈদ্যনাথকে কথা শেষ করতে না দিয়েই হাঁক দিলেন— ‘দারোয়ান!’
ডাক শুনেই হন্তদন্ত হয়ে এসে দারোয়ান বৈদ্যনাথের উপর চোটপাট শুরু করে বললে—‘বহুৎ খতরনাক আদমি। রোজ ইধর আ কে দিল্লগি করতে হৈ। নিকালে ইধার সে বেত্তমিজ্।’
প্রচণ্ড ধমক দিয়ে ডাঃ রায় বললেন—‘খবরদার। কোনো লোকের সঙ্গে এভাবে কথা বলবে না।’
ধমক খেয়েই দারোয়ান কাঁপতে-কাঁপতে সেলাম ঠুকে বললে—‘যো হুকুম সাব।’
ডাঃ রায় বৈদ্যনাথকে দেখিয়ে বললেন, ‘এই ছেলেটি যখনই আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে, ওকে ঢুকতে দিও।’
পরমুহূর্তেই বৈদ্যনাথের দিকে তাকিয়ে বললেন—‘কাল সকালে এসো। আজ আর কথা বলবার সময় নেই।’
পরদিন সকালে বেলা আটটার সময় বৈদ্যনাথ ডাঃ রায়ের বাড়িতে উপস্থিত। আজ অবারিত দ্বার, দারোয়ান স্মিতহাস্যে অভ্যর্থনা জানাল। সকাল বেলায় বাড়িতে রুগী দেখা শেষ করে ডাঃ রায় তাঁর লাইব্রেরী ঘরের টেবিলে বসে কাগজপত্র দেখছিলেন। বৈদ্যনাথ সরাসরি সেখানে উপস্থিত হতেই ডাঃ রায় বললেন—‘এসেছো? দারোয়ান তাহলে ঢুকতে দিল তোমাকে।’
বৈদ্যনাথ হেসে বললে—‘কাল যখন আপনি নিজে বলে দিয়েছেন তখন কার সাধ্যি আমাকে আটকায়!’
বৈদ্যনাথের কথা শুনে ডাঃ রায় কৌতুক করে বললেন—‘আমি না বলে দিলেও তোমাকে কি কেউ আটকাতে পেরেছিল? যাক্, যে-জন্য তোমায় ডেকে পাঠিয়েছি। আমার কিছু ব্যক্তিগত কাজ আছে, তোমায় করে দিতে হবে। তোমার ইংরিজি হাতের লেখা আমার খুব পছন্দ। মেডিকেল জার্নালের জন্যে আমাকে মাঝে-মাঝে কিছু লিখতে হয়। আমার হাতের লেখা যেমন অস্পষ্ট তেমনি কাটাকুটিতে ভরা। টাইপিস্টরা ‘অনেক সময় বুঝতে পারে না। প্রচুর ভুল থেকে যায়। রোজ সকালে এক ঘণ্টা, এই ধরো আটটা থেকে ন’টা, তুমি আমার এখানে এসে লেখাগুলি নকল করে দেবে। তারপরে একবার চোখ বুলিয়ে দেখে টাইপিস্টকে দেব। পারবে তো?’
বৈদ্যনাথ খুশি হয়ে বললে—‘হাসপাতালে আমার ডিউটি শুরু হয় দশটার পর। সুতরাং এক ঘণ্টা কেন, সকালে যতক্ষণ প্রয়োজন আপনার কাজ করে দেব।’
‘ঠিক আছে। তা হলে কাল থেকেই লেগে যাও। হাসপাতালে কত মাইনে তুমি পাও?’
‘আজ্ঞে পঁচিশ টাকা পাই।’
‘বেশ, আমিও তোমাকে পচিশ টাকাই দেব। তাতে কুলোবে তো?’
বৈদ্যনাথ যেন হাতে চাঁদ পেল। বিস্মিত হয়ে বললে—‘কুলোবে! কি বলছেন স্যার! আমি তো ভাবছি কলকাতায় বাসা ভাড়া করে মাকে চাঁদপুর থেকে এনে আমার কাছেই রাখব।’
ডাঃ রায় গম্ভীর হয়ে বললেন—‘অত উৎফুল্ল হয়ে উঠে না বৈদ্যনাথ। কলকাতা শহরকে তোমার চেয়ে বেশি চিনি আমি। ও-টাকায় কলকাতায় বাড়ি ভাড়া করে মাকে এনে রাখা চলে না। ওতে মা’রই কষ্ট হবে বেশি। আরো কিছুদিন অপেক্ষা করো।’
পরদিন থেকে রোজ সকালে সাতটার মধ্যেই বৈদ্যনাথ ডাঃ রায়ের বাড়ি চলে আসে।
লেখা কপি করার কাজ প্রথমেই অতি যত্নের সঙ্গে সেরে রাখে। পরে হাতে কিছু সময় থাকলে ডাঃ রায়ের লাইব্রেরীর ডাক্তারী বই ও বিদেশ থেকে আসা মেডিকেল জার্নালগুলি গুছিয়ে রাখে। কিছুদিনের মধ্যেই বৈদ্যনাথ ডাঃ রায়ের লাইব্রেরী ঘরের যাবতীয় বইপত্র সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়ে গেল। লেখার পাণ্ডুলিপি রিভাইজ করবার সময় রেফারেন্সের জন্যে কোনো বই বা পুরোনো জার্নালের প্রয়োজন হলে তৎক্ষণাৎ বৈদ্যনাথ তা ডাঃ রায়ের হাতে হাজির করে দেয়।
॥ ছয় ॥
বেশ কয়েক মাস কেটে যাবার পর ডাঃ রায়ের লেখাও কমে আসতে লাগল, লিখবার সময়ও পেতেন না একেবারেই। হাসপাতালে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন, খুব কঠিন কেস না হলে প্রাইভেট প্র্যাকটিসও বড় বেশি একটা করেন না। শুধু সকাল বেলায় বাড়িতে রুগী দেখা আগের মতনই আছে। রাজনীতির সঙ্গে ডাঃ রায়ের পরোক্ষ যোগাযোগ ছিল চিত্তরঞ্জন দাশের আমল থেকেই, এখন প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়লেন। বাড়িতে দেশ-নেতাদের নিত্য আসা-যাওয়া শুরু হয়ে গেল! আসছেন জওহরলাল, আসছেন রাজেন্দ্রপ্রসাদ, আসছেন সরোজিনী নাইডু। মহাত্মা গান্ধীও কখনো কখনো আসছেন। সেই সঙ্গে সাহেবসুবার আনাগোনা বেড়ে গেল। সব দল আর সব সম্প্রদায়ের মধ্যমণি হলেন ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়।
বৈদ্যনাথ প্রতিদিন সকালে নিয়মিত আসে কিন্তু কাজ কিছুই নেই। লেখা নকল করার আর প্রয়োজন নেই, ডাঃ রায়ের লেখার সময় কোথায়? লাইব্রেরী ঘরের বই আর কাগজপত্র গুছিয়ে রাখা, সে তো পনেরো মিনিটের কাজ। কিন্তু মাসে মাসে মাইনে সে ঠিকই পেয়ে যাচ্ছে। কাজ নেই, অথচ মাইনে নেওয়া!
বৈদ্যনাথের আত্মসম্মানে ঘা লাগল। সে-কথা ডাঃ রায়কে সে নিজের মুখে বলবে সে ফুরসত কোথায়!