বৈদ্যনাথ বললেন—‘এমন কিছু না। নাইট ডিউটি চলছে কিনা তাই। এই ফর্মটায় একটা সই করে দেবেন স্যার?’
ডাঃ রায় বললেন—‘ও-সব এখন থাক। আমি পরশু সকালে কলকাতার বাইরে যাচ্ছি। ঘুরে আসি, তখন দেখা কোরো।’
হাত-ঘড়িটার দিকে তাকিয়েই ড্রাইভারকে গাড়ি ছাড়বার আদেশ দিলেন। গাড়ি চলে গেল, রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল বৈদ্যনাথ।
বৈদ্যনাথের কাছে সব বৃত্তান্ত শুনে সুপারিন্টেণ্ডেট বললেন—‘তাই তো, ডাঃ রায় সই করলেন না! তবে তো তোমার একটা বছর নষ্ট হল।’
বৈদ্যনাথ মুষড়ে পড়ল। ডাঃ রায় ওকে যখন একটা চাকরিই দিলেন তখন সে-চাকরিতে উন্নতির সুযোগটুকুই বা করে দিলেন না কেন? ডাঃ রায়ের এই বিমুখতা বৈদ্যনাথের কাছে একটা রহস্য হয়ে রইল। তবু সে সুপারিন্টেণ্ডেন্টকে জিজ্ঞাসা করল—‘অন্য কোন ডাক্তারকে দিয়ে সই করিয়ে নিলে ভর্তি হওয়া যাবে কি?’
সুপারিন্টেণ্ডেন্ট বললেন—‘তা যাবে না কেন। কিন্তু ডাঃ রায় যখন জেনেশুনেই সই করলেন না এবং শিলং থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বললেন, তখন নিশ্চয় কোনো একটা কারণ আছে। তোমাকে আর ওয়ার্ড অ্যাসিস্টেন্ট-এর কাজে রাখা যাবে না—ওটা বে-আইনি হবে। তিন মাসের কোর্সটা শেষ করলে আর কোনো অসুবিধাই হত না।’
বৈদ্যনাথ উদ্গ্রীব হয়ে জিজ্ঞাসা করল—‘উনি ক’দিনের জন্য শিলং যাচ্ছেন?’
‘কাল সকালেই যাচ্ছেন এবং তিন সপ্তাহের জন্য। সুতরাং তিন সপ্তাহ কোর্স অটেও না করলে এ-বছরে তো আর ও-কাজে তোমাকে নেওয়া চলবে না।’
পরদিন সকালে বৈদ্যনাথ সোজা হাজির শিয়ালদা স্টেশনে। আসাম মেল দাঁড়িয়ে আছে, ফাস্ট ক্লাস কম্পার্টমেন্ট-এর দিকে খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে বৈদ্যনাথ দেখতে পেল একটা সাদা কার্ড বসানো। লেখা আছে— Dr. B. C. Roy.
ট্রেন ছাড়তে তখনও মিনিট পাঁচ বাকি, ডাঃ রায়ের দেখা নেই। অধীর হয়ে বৈদ্যনাথ কম্পার্টমেন্ট-এর সামনের প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করতে লাগল, হাতে ধরা আছে সেই ফর্ম। আরো দু-মিনিট পার হয়ে গেল, ডাঃ রায়ের তখনো দেখা নেই। ট্রেনের গার্ড আর স্টেশন মাস্টার উদ্গ্রীব আগ্রহে ডাঃ রায়ের কম্পার্টমেন্ট-এর সামনে দাঁড়িয়ে। ডাঃ রায় এখনো পৌঁছলেন না, তাই নিয়ে দুজনেই উদ্বিগ্ন।
আর যখন দু-মিনিট বাকি তখন দূরে দেখা গেল ডাঃ রায়কে। কাঁটায় কাঁটায় প্ল্যাটফর্মে ঢুকছেন।
পুরো সাহেবী পোশাক কিন্তু গলায় টাই নেই। স্টেশন মাস্টার ও গার্ড ওঁকে দেখে নিশ্চিন্ত হল, বৈদ্যনাথও। কম্পার্টমেন্টের কাছে আসামাত্র বৈদ্যনাথ হাতের ফর্মটা তাড়াতাড়ি ওঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললে—‘স্যার একটা সই করে দিন, না দিলে আমার চাকরি হবে না।’
বৈদ্যনাথকে এখানেও দেখে ডাঃ রায় বিরক্তি প্রকাশ না করে চোখে- মুখে একটা বিস্ময় এনে বললেন—‘তুমি এখানেও ধাওয়া করেছ? আমি তো বলেইছি ফিরে এসে যা করবার করব।’
এক নিশ্বাসে বৈদ্যনাথ সুপারিন্টেণ্ডেণ্টের কথাগুলি ডাঃ রায়ের সামনে বলে গেল। হঠাৎ ডাঃ রায় প্যান্টের পকেট ও কোটের পকেট হাতড়াতে লাগলেন। কী একটা যেন খুঁজলেন, পেলেন না। সামনেই প্ল্যাটফর্মের উপর একটা পরিত্যক্ত সিগারেটের প্যাকেটের উপর দৃষ্টি পড়ল। আশে-পাশে এত লোক থাকতে কাউকে কিছু বললেন না। নিজেই দু’পা এগিয়ে গেলেন। বিশাল বপু নুয়ে পড়ল প্ল্যাটফর্ম-এর উপর। সিগারেটের প্যাকেটটা কুড়িয়ে নিলেন। প্যাকেটের খোলটা ফেলে দিয়ে ভিতরের সাদা অংশটুকু বার করে তার উপর লিখে দিলেন—
Give him some light work. —B. C. Roy.
কাগজটা বৈদ্যনাথের হাতে দিয়ে শুধু বললেন—‘সুপারিন্টেণ্ডেকে কাগজটা দেখিও।’
গাড়ি ছাড়তে এক মিনিট লেট্ হয়ে গিয়েছে। ডাঃ রায় তাড়াতাড়ি কম্পার্টমেন্ট-এ উঠে বসতেই গার্ড হুইসিল দিল, গাড়িও চলতে শুরু করেছে। বৈদ্যনাথ প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে যাওয়া গাড়িটার দিকে স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল।।
ডাঃ রায়ের লেখা চিরকুট দেখে সুপারিন্টেণ্ডেন্ট হেসে ফেললেন। মনে মনে তারিফ করলেন বৈদ্যনাথের অদম্য উৎসাহের। খুশি হয়েই ওকে এবার হালকা কাজ দিলেন, রেকর্ড ক্লার্ক-এর কাজ। প্রত্যেক রুগীর জন্য ডাক্তাররা যে প্রেসক্রিপশন লিখে দেন তা অন্য একটা খাতায় নকল করে রাখাই হল বৈদ্যনাথের এখন একমাত্র কাজ।
তিন সপ্তাহ বাদে শিলং থেকে ফিরে এসে ডাঃ রায় যথারীতি হাসপাতালে রুগী দেখতে যান কিন্তু বৈদ্যনাথের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। বৈদ্যনাথের মাইনে কুড়ি টাকায় শুরু হয়েছিল, ইতিমধ্যে আরো পাঁচ টাকা বেড়েছে। প্রতি মাসেই সে পাঁচ টাকা নিজের জন্য রেখে বাকি কুড়ি টাকা মা’র কাছে পাঠিয়ে দেয়। মাকে চিঠি লিখে জানিয়ে দিয়েছে সে পঁচাত্তর টাকা মাইনে হলেই সে কলকাতায় বাড়ি ভাড়া করবে এবং মাকে নিয়ে আসবে।
জরুরী প্রয়োজনে ডাঃ রায়ের একদিন তাঁরই এক রুগী সম্পর্কে পুরোনো প্রেসক্রিপশনটা একবার দেখা দরকার হল। সুপারিন্টেণ্ডেন্ট আপিস থেকে খাতাটা এনে ডাঃ রায়কে দিলেন। খাতাটার পাতা উল্টে দেখতে দেখতে ডাঃ রায় বললেন—‘হাতের লেখাটা কার?’
‘রেকর্ড ক্লার্ক-এর স্যার।’
‘তা আমি জানি। লোকটি কে?’
সুপারিন্টেণ্ডেন্ট বরাবরই বৈদ্যনাথের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন। ডাঃ রায়ের প্রশ্ন শুনে ভয় হল, খাতা লিখতে বৈদ্যনাথ কি কিছু গণ্ডগোল করে বসেছে? তবু ডাঃ রায় যখন জানতে চেয়েছেন নামটা লুকোনো অনুচিত বিবেচনা করেই বললেন—‘বৈদ্যনাথ স্যার। সে তো এই হাসপাতালে আপনারই রুগী ছিল, আপনিই তাকে কাজ দিতে বলেছিলেন।’