বৈদ্যনাথ নিরুত্তর।
ডঃ রায় লেখা থামিয়ে রুগীর মুখের দিকে তাকিয়েই অবাক।
‘সে কি, তুমি এখানে কেন? তোমার তো রোগ সেরে গিয়েছে।’
বৈদ্যনাথ দ্বিরুক্তি না করে অসংকোচে বলল—‘আপনি আমাকে হাস-পাতাল থেকে ছুটি দিয়েছেন বটে, কিন্তু আমি কোথায় যাব, কোথায় থাকব? আমার তো চাকরিও নেই।’
গম্ভীর হয়ে ডাক্তার রায় বললেন—‘আমার কাজ রুগীর চিকিৎসা করা। কারো চাকরি করে দেওয়া আমার কাজ নয়।’
বৈদ্যনাথ তখন মরিয়া হয়ে গেছে। বলল—‘আমাকে যদি একটি চাকরি না দেন তাহলে আমার মা না খেতে পেয়ে মরবে, আমি না খেতে পেয়ে মরব।’
টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লেন ডাঃ রায়। ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন—‘চাকরির খোঁজে আমার কাছে কেন? আরও তো অনেক লোক আছে শহরে, তাদের কাছে চেষ্টা করে।’
তখনো ডাঃ রায়ের পিছন ছাড়েনি বৈদ্যনাথ। সে বললে— ‘কলকাতায় এসে ছ’মাস আমি পরিচিত অপরিচিত বহু লোকের সঙ্গে দেখা করেছি। বছ আপিসে উমেদারী করেছি। চাকরি পাইনি। শেষকালে ওষুধের ল্যাবরেটরিতে কুড়ি টাকা মাইনের কাজ পেয়েছিলাম, তা-ও আমার ভাগ্যে সইল না। কাল সেখানে খোঁজ নিতে গিয়ে শুনি আমার জায়গায় অন্য লোক নেওয়া হয়েছে, বাড়তি লোক রাখার মতো ক্ষমতা ওদের নেই। আপনি আমার জীবন ফিরিয়ে দিয়েছেন, আপনার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তবু আপনাকে চাকরির কথা বলতে এসে বিরক্ত করছি এই জন্যে যে, আপনার কাছেই শেষ চেষ্টা করে দেখব। যদি ব্যর্থ হই আত্মহত্যা করা ছাড়া আমার কোনো উপায় নেই।’
একটা কাঁপা উত্তেজনায় এক নিশ্বাসে কথাগুলি বলে বৈদ্যনাথ থামল। ডাঃ রায় ততক্ষণে লিফ্টের কাছে এসে গিয়েছেন। লিফ্টম্যান দরজা খুলে তাঁরই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। লিফ্টে উঠতে গিয়েও কী ভেবে ডাঃ রায় উঠলেন না। বৈদ্যনাথের মুখের দিকে একবার তাকালেন—যেমনভাবে রুগীর মুখের দিকে তাকান রোগ নির্ণয়ের আগে।
কিছুক্ষণ নীরব থেকে ডাঃ রায় কি একটা চিন্তা করে বললেন— ‘কলকাতায় তোমার আত্মীয়স্বজন কেউ নেই?’
‘আছে। কিন্তু তাদের কাছে হাত পাততে যাব না।’ কথাটা দৃঢ়ভাবেই বলল বৈদ্যনাথ।
‘বুঝেছি। তা আমার কাছে তুমি কী চাকরি চাও আর কী কাজই বা তুমি করতে পারবে?
‘হাসপাতালের যে-কোনো কাজে যদি আমায় লাগিয়ে দেন।’
অবাক হয়ে ডাঃ রায় বললেন—‘হাসপাতালের কাজ? ট্রেনিং ছাড়া ওখানকার কোনো কাজই তুমি পারবে না।’
বৈদ্যনাথ বুঝতে পেরেছে ডুববার আগে একটা শক্ত খুঁটির আশ্রয় বুঝি পেল। দৃঢ়তার সঙ্গে সে বললে—‘আমার যোগ্যতা কি আছে না আছে তা আপনি ভালই জানেন। তবে এটুকু আমি বলতে পারি, যে-কাজই আপনি আমাকে দিন প্রাণপাত পরিশ্রমে আমি নিজেকে তার যোগ্য করে নেবই।’
লিফ্টে চড়ে উপরে না গিয়ে আবার রুগী-দেখার ঘরে ফিরে এলেন ডাঃ রায়। টেবিল থেকে একটা প্যাড তুলে কী সব লিখে কাগজটা বৈদ্যনাথের হাতে দিয়ে শুধু বললেন—‘সুপারিন্টেণ্ডেন্ট-এর সঙ্গে এই চিঠি নিয়ে দেখা কর।’
ডাঃ রায় লিফ্টে চড়ে উপরে উঠে গেলেন। তাঁর হাতের লেখা কাগজটা মুঠো করে ধরে রইল বৈদ্যনাথ। বহু আকাক্ষিত অমূল্য বস্তু তার হাতের মুঠোয়। এতদিন পরে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার এক অনাস্বাদিত আনন্দে সে অভিভূত হয়ে পড়েছে। অনেক দুঃখের দিন বৈদ্যনাথের জীবনে এসেছে, কোনোদিন চোখের জল সে ফেলেনি। আজ তার দুই চোখ জলে ভরে এল।
০৫. ডাঃ রায়ের চিঠি
॥ পাঁচ ॥
ডাঃ রায়ের চিঠি নিয়ে সুপারিন্টেণ্ডেন্ট-এর সঙ্গে দেখা করতেই সঙ্গে সঙ্গে বৈদ্যনাথের চাকরি হয়ে গেল। ওয়ার্ড অ্যাসিস্টেন্ট, কুড়ি টাকা মাইনে। হাসপাতালেই থাকার জায়গা পেয়ে গেল, খাওয়াটা ফ্রি। ডাঃ রায় হাসপাতালে ভিজিট করতে এলে দূর থেকে বৈদ্যনাথ দুই হাত তুলে নমস্কার জানায়। কোনোদিন নজরে পড়ে, কোনোদিন পড়েও না। অ্যাসিস্টেন্ট পরিবৃত হয়ে রুগী দেখায় এত ব্যস্ত থাকেন যে এগিয়ে গিয়ে কথা বলার সুযোগ বড় একটা হয় না। কথা বলবার আর আছেই বা কী। যা চেয়েছিল তাকে তো তা দিয়েছেন। শুধু কৃতজ্ঞতা জানানো? সে তো মনে মনে দিবারাত্রই সে জানাচ্ছে।
দিন সাতেক কাজ করার পর সুপারিন্টেণ্ডেন্ট বৈদ্যনাথকে ডেকে বললেন—‘ট্রেনিং-এর জন্যে তোমাকে তো একটা কোর্স নিতে হবে। কাল থেকেই তা শুরু হচ্ছে, তুমি ভতি হয়ে যাও। তিন মাসের এই ট্রেনিং কোর্সটা না নেওয়া থাকলে তোমার কাজের যোগ্যতাই প্রমাণিত হবে না, উন্নতিও করতে পারবে না।’
বৈদ্যনাথের হাতে একটা ফর্ম দিয়ে আবার বললেন—‘এইটে ভর্তি করে আনো আর সেই সঙ্গে দু’জন ডাক্তারের রেকমেণ্ডেশন দরকার। তবে তুমি যদি ডাঃ রায়ের একটা সই এই ফর্মে সই করিয়ে আনতে পার তাহলে আর কারো স্বাক্ষরের প্রয়োজন হবে না।’
পরদিন সকালে ফর্ম টা হাতে করে আবার সে গেল ডাঃ রায়ের বাড়ি। আবার সেই এক কথা—‘ছিলিপ লাগাও।’ বৈদ্যনাথ জানে স্লিপ দিলেও তার ডাক আসবে না। সুতরাং সে ফুটপাথেই পায়চারি শুরু করে দিল।
ন’টা বাজতেই ডাঃ রায় বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠতে যাবেন, এমন সময় বৈদ্যনাথ সামনে এসে হাজির। ওকে দেখেই ডাঃ রায় বললেন—‘তুমি এখানে কেন? আবার কী হল।’
তাড়াতাড়ি ফর্মটা এগিয়ে দিয়ে বললে—’একটা সই করে দিন স্যার।’
সেদিকে লক্ষ না করে এবং বৈদ্যনাথের কথায় কান না দিয়ে গাড়িতে উঠে বসলেন। ড্রাইভারকে একটু অপেক্ষা করতে বলেই বৈদ্যনাথকে বললেন—‘তোমার চেহারাটা এত খারাপ দেখছি কেন?’