সে কথা বলাতে শব্নম বললে, ‘বহুকাবুলীকে আধঘণ্টা ধরে বোঝাতে হয়।’
আমি বললুম, আমার একটা কথা মনে পড়েছে।
‘শাবাশ।’ বলে জানু পেতে বসে, ডান কনুই হাঁটুর উপর, হাত গালের উপর রেখে, কাৎ হয়ে, চোখ বন্ধ করে বললে, বল।
‘মজনূঁর শেষ প্রাণ-নিঃবাস করে লীন ধরাতলে
সেই নিশ্বাস ঘূর্ণির রূপে লায়লীকে খুঁজে চলে।’
‘বুঝেছি। কিন্তু আরও বুঝিয়ে বল।’
আমি বললুম ‘মজনূঁ যখনই শুনত, তার প্রিয়া লায়লীকে নজদ মরুভূমির উপর দিয়ে উটে করে সরানো হচ্ছে সে তখন পাগলের মত এ-উট সে-উটের কাছে গিয়ে খুঁজত কোন মহমিলে (উটের হাওদা) লায়লী আছে। মজনূঁ মরে গেছেন কত শতাব্দী হল। কিন্তু এখনো তার জীবিতাবস্থার প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস মরুভূমির ছোট ছোট ঘূর্ণিবায়ু হয়ে লায়লীর মহমিল খুজছে। তুমি বুঝি কখনো মরুভূমি দেখ নি? ছোট ছোট ঘূর্ণিবায়ু (বগোলে) অল্প অল্প ধূলি উড়িয়ে এদিকে ধায়, ওদিকে ছোটে, সেদিকে খোজে?’।
না। কিন্তু মানুষের কল্পনা কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে তাই দেখে অবাক মানছি। উর্দুটা বল।
“মজনূঁকে দকী রনক মুদ্দৎ ই সিধার
অব ফৌ নজকে বগোলে মলিকো টুড়তে হৈ?”
এর ছ’টা শব্দ ফার্সী। শব্নম বুঝে গেল। বললে, ‘অতি চমৎকার দোহা।’
আমি একটু কিন্তু কিন্তু করে বললুম, বড্ড বেশী ঠাস বুনোট। আমার বুঝতে বেশ কষ্ট হয়েছিল।
বললে, তার পর তুমি একে শুধালে “শব্নম বানু কোথায় থাকে?” ওকে শুধালে, “সে কখন বেড়াতে বেরয়?”—ভাবলে কেউই তোমার গোপন খবর জানে না।
‘আমি কি এতই আহাম্মুক!’
আমার ডান হাতে হাত বুলাতে বুলাতে বললে, শোন দিল-ই-মন, (আমার দিল) -মুর্খই হও আর সোক্রাৎই (সক্রাটিস) হও, প্রেম কেউ লুকিয়ে রাখতে পারে না। শোন,
“দিল গুমান দারদ কি পূশীদে অন্ত রাই-ই ইশকরা
শমরা ফানুস পদারদ কি পিনহা করদে অস্ত।
সরল হৃদয় মনে করে প্রেম লুকায়ে রাখিতে পারে,
কাচের ফানুস মনে মনে ভাবে লুকায়েছে শিখাটারে।”
কে পারে? কেউ পারে না। আজ না হয় কাল ধরা পড়বেই। আমি পারি? এই তো তুমি যে আমায় নেবুটি দিয়েছিলে—আমি সেটি নখ দিয়ে অল্প অল্প ঠোনা দিয়ে শুঁকছিলুম। হঠাৎ বাবা এসে শুধোলেন, “নেবু যে! কোথায় পেলে।” আমি বললুম, “হোটেলে চা খেতে গিয়েছিলুম”-বাবা জানতেন, “সেখানে জুটল।” আমার মুখ যে তখন লাল হয়ে যায় নি, কি করে বলব? আবা বললেন যে, তিনিও লাঞ্চে একটা পেয়েছিলেন। কে দিলে, কি করে পেলে কিছু শুধালেন না। তিনিও একদিন জানবেন।
তখন?
তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি তো বিদেশী। আমার, শুধু আমার, আপন-দেশী। তোমার ভাবনা ভাববো আমি। বলেছি তো আমার কাছে ওষুধ আছে। ওসব কথা ছাড়। একটা কবিতা বল- আমাদের কথার সঙ্গে খাপ খাক আর নাই খাক।
আমি বললুম, খাপ খাইয়েই বলছি। তোমার মুখ লাল হওয়ার সঙ্গে তার মিল আছে, আবার কাচের চিমনি যে গর্ব করে সে প্রদীপের আলো লুকিয়েছে তার সঙ্গেও মিল আছে। তবে এটা সংস্কৃতে এবং শ্লোকটার ভাবার্থ শুধু আমার মনে আছে :
“শুধাইনু, হে নবীনা,
ভালোবাস মোরে কি না?
রাঙা হল তার মুখখানি;
প্রেম ছিল হৃদে ঢাকা।
তাই যবে হয় আঁকা
আকাশেতে লাল রঙ, জানি–
পাহাড়ের আড়ালেতে
সবিতা নিশ্চয় ভাতে
রক্তাকাশ তাই নেয় মানি।”
শব্নম বললে, আবার বল।
বললুম।
শব্নম বললে, এটি অতুলনীয়। বিশেষ করে প্রেমের সঙ্গে সূর্যেরই শুধু তুলনা হয়। আকাশ আর মুখ এক। ঘড়ি ঘড়ি রঙ বদলায়। সূর্য চিরন্তন। প্রেম সূর্য একবার দেখা দিলে আর কোন ভাবনা নেই, চিন্তা নেই।
আমি বললুম, ‘তোমার বেলা একটা নেবুতেই মুখ লাল হয়ে গেল। প্রেম হলে কি হত?’
বিরক্তির ভান করে বলল, “কি বললে? প্রেম নেই?”
আমিও বেদনার ভান করে বলল, তুমিই তো বললে নেবুর ভিতর টক।
ও! আমি বলেছিলুম, ‘আঙুরগুলো টক’—সেই অর্থে। তোমাকে পাব না ভয়ে শেয়ালের মত মনকে বোঝাচ্ছিলুম।
‘তোমার সঙ্গে কথায় পারা ভার। তবে আরেকটা ফরিয়াদ জানাই।’
গভীর মনোযোগ সহকারে, অত্যন্ত দোষীর মত চেহারা করে বললে, “আদেশ কর।”
আমি বললুম, ‘আমার উচ্চারণে ঠাকুরমার সিন্দুকের গন্ধ।
খলখল করে হেসে উঠল; আচ্ছা পাগল তো! সার্থক নাম রেখেছিলেন তোমার আব্বা-জানের মুরশীদ। ওরে, মজনূঁন সেই ভাল। জানেমন্ বলছিল-
বাধা দিয়ে বললুম, সে আবার কে?
দুষ্ট মেয়ে। বুঝে ফেলেছে। ভুরু কুঁচকে শুধালে, ‘হিংসে হচ্ছে?’
আমি বললুম, হ্যাঁ।
আনন্দে আলিঙ্গন করতে গিয়ে যেন নিজেকে ঠেকালে। হাসিতে খুশিতে কামাতে মেশানো গলায় বললে, বাঁচালে, বাঁচালে, আমাকে বাচালে।
অবাক হয়ে শুধালুম মানে?
বাঁচালে, বাঁচালে। গুণী-জ্ঞানীরা বলেন, প্রিয়জনের মঙ্গলের জন্য তাকে যোগ্যতর ব্যক্তির হাতে তুলে দেবে, আত্মবিসর্জন করে নিজেকে মিলিয়ে দেবে—মানি নে, মানি নে, আমি একদম মানি নে। আজ যদি গওহরশাদ কিংবা নূরজাহান তোমাকে ভালবেসে পেতে চান—
আমি বললাম, শাবাশ।
‘কি বললে? শাবাশ? দেখাচ্ছি। প্রথম মারব ওদের। তখন যদি তুমি শাবাশ বল তবে বেঁচে গেলে। না হলে তোমাকে মেরে, ধেতলে, পিষে শামী কাবাব বানাব, নিদেন পক্ষে শিক। হ্যাঁণ্ডব্যাগ খুলে পিস্তল দেখালে।
আমি বললুম, ওতে বুলেট থাকে না।
‘সেদিনও ছিল।’
জানেমন্ কে?
‘আমার জিগরের টুকরো, কলিজার আধা, দিলের খুন, চোখের রোশনাই, জানের মালিক—আমার জ্যাঠামণি। তোমার কাছে সিগারেট আছে। দাও তো।’