মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দুহাত দিয়ে আমার মাথার দুদিক চেপে ধরে হাসতে হাসতে বললে, আমি ভেবেছিলাম তুমি বিদ্রোহ ঘোষণা করে চিৎকার করে বলবে, “না, তুমি আমার বশ্যতা স্বীকার কর”।
আমি বললুম, আমাদের বাউল গেয়েছেন-একটু বদলে বলছি,-
“কোথায় আমার দু-দণ্ড কোথায় সিংহসন?
প্রেমিকার পায়ের তলায় লুটায় জীবন।”
‘বেশ তো! তুমি ফার্সী শিখছ; আমি তা হলে বাঙলা শিখব।’
সর্বনাশ! অমন কর্মটি করো না।
“কেন?”
‘তিন দিনে ধরে ফেলবে, আমি কত কম বাঙলা জানি।’
যেন আমার কথা শুনতেই পায় নি। বললে, “তুমি মুসাফির; কিন্তু ঘরটি সাজিয়েছ বেশ।” ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বেশ ঘুরে ঘুরে চতুর্দিক দেখলে। তারপর সোফাতে বসে বললে, এস। আমি পাশে বসতে যেতেই বললে, না, চেয়ারটা সামনে টেনে এনে বোস। আমি একটু ক্ষুন্ন হলুম। বললে, ‘মুখোমুখি হয়ে বোস। তোমার মুখ দেখব।’ তদ্দণ্ডেই মনটা খুশী হয়ে গেল—মানুষ কত সহজে ভুল মীমাংসায় পৌঁছয়!
আমি কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে বললুম, তুমি ওই তাম্বু, মানে বোরকা পর কেন?
‘স্বচ্ছন্দে যেখানে খুশী আসা-যাওয়া করা যায় বলে। আহাম্মুখ ইউরোপীয়ানরা ভাবে, ওটা পুরুষের সৃষ্টি, মেয়েদের লুকিয়ে রাখার জন্য। আসলে ওটা মেয়েদেরই আবিষ্কার -আপন সুবিধের জন্য। আমি কিন্তু মাঝে মাঝে পরি, এদেশের পুরুষ এখনো মেয়েদের দিকে তাকাতে শেখেনি বলে—হ্যাটের সামনে পর্দায় আর কতটুকু ঢাকা পড়ে?’ তারপর বললে, “আচ্ছা, বল তো, তুমি পাগমান থেকে পালিয়ে এলে কেন?”
বললুম, আমি তো খবর পেলুম, তুমি কাবুল চলে এসেছ।
আমি তার পরদিনই পাগমান গিয়ে শুনি, তুমি কাবুলে চলে এসেছ।
আমি শুধুলাম, “আচ্ছা, বল তো, আমাদের বন্ধুত্ব এত তাড়াতাড়ি হল কি করে?”
‘আজব বাৎ শুধালে! তবে কি বন্ধুত্ব হবে যখন আমার বয়স ষাট আর তোমার বয়স একশ তিরিশ?’
আমি শুধালুম, ‘আমাদের বয়সে কি এতই তফাৎ?’
‘তোমার গম্ভীর গম্ভীর কথা শুনে মনে হয় তারও বেশী। আবার কখনো মনে হয়, তুমি আমার চেয়ে অনেক ছোট। কিন্তু আসল উত্তর নয়। আসল উত্তর আরেক দিন বলব।’
বলবে তো ঠিক?
নিশ্চয়।
‘আচ্ছা, এবারে তোমাকে একটা শেষ প্রশ্ন শুধাই। তুমি এত সাহস কোথায় পেলে? এই যে স্বচ্ছন্দে বল, কোনো কিছুর পরোয়া তুমি কর না, সোজা আমার বাড়িতে চলে এলে-?’
‘তুমি আমাকে ভালোবাস—আমি তোমার বাড়িতে আসব না তো যাব কি গুল-ই-বাকাওলীর পরিস্তানে? জান, আমরা আসলে তুর্কী। আমাদের বাদশা আমানল্লার গায়েও তুর্কী রক্ত আছে। আর তুর্কী রমণী কি জিনিস সেটা জানতেন আমানুল্লার বাপ শহীদ হবীবুল্লাহ। আমানুল্লাহর মায়ের প্যাঁচে তিনি পর্যন্ত হার মেনেছিলেন, জান? আমানুল্লাহর তো রাজা হওয়ার কথা ছিল না।
কিছু কিছু শুনেছি।
‘ভালো। গওহর শাদের নাম শুনেছ? ওই সুন্দর হিরাত শহরের চোদ্দ আনা সেই তুর্কী রমণীর তৈরী। তোমার আপন দেশে নূরজাহান বাদশা জাহাঙ্গীরকে চালাত না? মোমতাজ—আরো যেন কে কে? হারেমের ভিতরেই তুর্কী রমণী যে নল চালায় সেটা কতদূর যায় তার খবর রাখে কটা লোক?’
‘তুমি অত ইতিহাস পড়লে কোথায়?’
‘আমি পড়ি নি। আমি ইতিহাস, দর্শন, ভূগোল, এসব পড়ি নে। আমার আনন্দ শুধু কাব্যে। স্কুলে বাধ্য হয়ে ‘তুর্কী রমণীর ইতিহাস’ পড়তে হয়েছিল তার থেকে বলছি। কিন্তু তাই বলে ভেবো না, আমি আমার বে-পরোয়া ভাব ইতিহাস থেকে পেলুম। আর জান না, কবি কামালুদ্দীন কি বলেছেন,-
“মরণের তরে দুটি দিন তুমি করো নাকো কোনো ভয়,
যেদিন মরণ আসে না; সেদিন আসিবে সে নিশ্চয়।”
আমি বললুম, ‘মৃত্যু ছাড়া অন্য বিপদও তো আছে।’
‘কী আশ্চর্য! মৃত্যুর ওষুধই যখন পাওয়া গেল তখন অন্য ব্যামোর ওষুধ মিলবে না? তোমার বিপদ, আমার বিপদ, আমাদের দুজনের মেলানো বিপদ—তার দাওয়াই আমার কাছে আছে। কিন্তু বলব না।’ ‘কেন?
‘ওষুধের রসায়ন (প্রেসক্রিপশন) জানাজানি হয়ে গেলে রোগী সারে না—হেকিমদের বিশ্বাস। তার পর সোফার কুশনগুলো জড়ো করে বালিশ বানিয়ে শুয়ে পড়ে বললে, ‘তুমি পাশে এসে বোস।’ একপাশে একটু জায়গা করে দিয়ে বললে, এ কথা কেন তোল? এখন বল, তুমি আমায় কোথায় কোথায় খুজলে? আমার শুনতে বড় ভালো লাগে।
আমি বললুম, ‘শব্নম বানু-’
‘উহুঁ। হল।’
কি?
শব্নম শিউলি।
এ নামে কত মধু ধরে। তাই বুঝি ‘জপিতে জপিতে নাম অবশ হৈল তনু।’
কবার জপেছিলুম?
শব্নম বললে, উত্তর দাও।
“তোমাকে আমি সবখানে খুঁজেছি।”
এতক্ষণ সে শিলওয়ার পরা ডান পা হাঁটুর উপর তুলে দিয়ে মোজাবিহীন ধবধবে ডান পায়ের বুড়ো আঙ্গুল আর তার পরের আঙ্গুল নিয়ে খেলা করছিল; কখনো বা ওড়নাখানি বা হাত দিয়ে তুলে ধরে ডান হাত দিয়ে তার খুঁট পাকাচ্ছিল।
ধরমড় করে সটান উঠে বসে বললে, “হ্যাঁ, হ্যাঁ। নদী-পাড়ে বলেছিলে। আমি তখন অর্থ বুঝি নি। এখন কবি জামী বুঝিয়ে দিয়েছেন। এক্ষুনি বলছি কিন্তু তার আগে বল, খোঁজার সময় যেকোন মেয়ে আসতে দেখলেই ভাবতে, আমি আসছি। না? শোন তবে;-
“আতুর হিয়ার নিদ-হারা চোখে
অহরহ তুমি স্বামী
দূর হতে দেখি যে কেহ আসিছে
তুমি এলে, ভাবি আমি
মুর্খ দাঁড়ায়ে আছিল সেখানে
শুধাল, রাসভ এলে?
কহিলেন জামী বলিব তো আমি
তুমিই এসেছ—হেলে।”
প্রথমটায় আমি ঠিক বুঝতে পারি নি! ভক্ত সাধকজন হঠাৎ একটা লোককে, আপন গা বাঁচিয়ে গাধা বানিয়ে দেবেন, এতখানি রসবোধ তাঁদের কাছে আশা করে কে?