এবারে যেন তার কান্না পেল। বললে, ‘ও! বুঝেছি। সাঁতার কাটবার ফুর্তি করতে এসেছিলেন।
এই এত দিনে আমার সত্যকার বাজল।
আজ না হয় ঠাট্ট-মস্কারা, রঙ্গ-রসিকতা করে মনের গভীর আবেগ, তার গোপন ক্ষুধা, তার অসম্ভব অসম্ভব স্বপ্ন-চয়ন, তার বদ্ধ পাগলামি যতখানি পারি ঢেকে চেপে বলছি কিন্তু তখন, হায়, এ হালকামি ছিল কোথায়?
বলুলম, “দেখুন, শব্নম বানু, আমি বিদেশী। বিদেশে অনেক মনোবেদনা। তার উপর যখন মানুষ ভালোবাসে-”
সঙ্গে সঙ্গে নিঃসঙ্কোচে শব্নম তার হাত দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরল।
আমি ভয়ে লজ্জায় মারা গেলুম। ছি ছি! আমি কী করে এ কথাটা বলে ফেললুম? কোথা থেকে আমার এ সাহস এল? কিন্তু আমি তো সাহসে বুক বেঁধে এ কথা বলি নি। এ তো নিজের থেকেই বেরিয়ে গিয়েছে।
তার চেয়েও আশ্চর্য, শব্নম আমার মুখের উপর তার হাতের চাপও ছাড়ছে না।
বলো না, বলো না। আমি ঠিক করেছিলুম ও কথাটা আমি আগে তোমাকে বলব।
দুজনাই অনেকক্ষণ চুপ!
শব্নমই প্রথম কথা বললে।
বললে, ‘আমি ভেবেছিলুম আমি প্রথম বলব, আর তুমি আমাকে অবহেলা করবে।’
আমি অবাক হয়ে বললুম, “সে কি?”
তাড়াতাড়ি বললে, থাক, থাক। আজ এসব না। অরেক দিন এসব কথা হবে। আজ শুধু আনন্দের কথা বল। সর্ব প্রথম বল, তুমি কখন আমাকে ভালোবাসলে?
আমি বললুম, “সে কি করে বলি? তুমি কখন বাসলে বল।”
উৎসাহের সঙ্গে বললে, সে অতি সহজ। হোটেলের বারান্দায় যখন তোমাকে ডেকে পাঠালুম। তুমি যখন কোনো কথাই খুঁজে পাচ্ছিলে না, তখন। জান না ইস্পাহানি কবি সাঈব্ কি বলেছেন,
“খমূশী হতে নাতি বুদ জুইআই-ই-গওহররা,
কি আজ গওওয়াস দর দরিয়া নফস বীরুন নমীআয়াদ।।”
‘গভীরে ডুবেছে যে জন জানিবে মুক্তার সন্ধানে,
বুদবুদ হয়ে তার প্রশ্বাস ওঠে না উপর পানে।।’
আমি বললুম, এ কবি সত্যই জীবন দেখেছিলেন কাবুলে এ কবি কিন্তু জন্মাতে পারত না।
“কেন?”
‘ডুব দেবার মত জল এখানে কোথায়?’
‘সে কথা থাক। আমার কিন্তু ভারী দুঃখ হয়, তুমি আমার বয়েতের পাল্টা বয়েৎ দিতে পার না বলে।’
আমি নিশ্বাস ফেলে বললুম, সে কি আমার হয় না।
‘চুপ। আবার ভুল করেছি। বলেছিলুম দুঃখের কথা তুলব না।’
আমি কিন্তু জোর ফার্সী শিখতে আরম্ভ করেছি।
কী আনন্দ! বাবার মজলিসে কত বিদেশী আসে, কেউ ভালো ফার্সী বলতে পারে না। তুমি শিখলে আমার খুব গর্ব হবে। তুমি আমারই জন্য শিখছ। সে আমি জানি।
‘তোমার মুখে ‘তুমি’ বড় সুন্দর শোনায়।’
বাধা পড়ল। কার যেন গলার আওয়াজ।
তাড়াহুড়ো না করে আস্তে আস্তে বললে, এবার তুমি এস। তোমাকে খুদার আমানতে দিলুম।
আমি জলে নামতে নামতে বললুম, আর কিছু বল।
‘আমি তোমাকে ভালোবাসি।’
১.৫ ঠেকেছিল মনোতরীখান
“ঠেকেছিল মনোতরীখান
প্রাণনাশা সংশয়-চড়ায়,
ভাষাহীন আশা পেয়ে আজ
হর্ষে সে চলে পুনরায়।
ছিল ঠেকে মনোতরীখান,–
চলিল সে কাহার ইঙ্গিতে?
কে গো তুমি দুর্জ্ঞেয় মহান?
কে দেবতা এলে আজি চিতে?”
যে চার্বাক ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন না, তিনি নাকি মঞ্জুভাষার কাছ থেকে তাঁর প্রেমের প্রতিদানের আশা পেয়ে একদিনের তরে ঈশ্বরে বিশ্বাস করেছিলেন।
“সেই একদিন শুধু জীবন চার্বাক
নত হয়েছিল নিজে চরণে
ধাতার প্রেমের কল্যাণে শুধু সেই একদিন,–
সে যে আনন্দের দিন সে যে প্রত্যাশার।।”
(সত্যেন দত্তের কবিতা)
আমি ছেলেবেলা থেকেই আল্লাকে ভয় করতে শিখেছি, কৈশোরে কাব্যে পড়েছি, তাঁকে নাকি ভালোবাসাও যায়, আর এই যৌবনপ্রদোষে এক লহমায় তিনি যেন হঠাৎ এক নবরাজ প্রেমরাজ হয়ে আমাকে ডেকে তার সিংহাসনের পাশে বসালেন। শুধু তাই! ক্ষণে ক্ষণে আমার দিকে তাকিয়ে আমার প্রেম নিবেদনেরও প্রতীক্ষা করছেন। তাঁর চোখেও যেন পাব-কি-পাব-নার ভয়! আশ্চর্য! আশ্চর্য!
“জ্ঞানের অগম্য তুমি প্রেমের ভিখারী
দ্বারে দ্বারে মাগো প্রেম নয়নেতে বারি!”
সব দ্বার ছেড়ে তিনি যেন একমাত্র আমারই দ্বারে এসেছেন।
না, না, তিনি দ্বারে আসেন নি। মৌলা-প্রভু-যখন আসেন, তখন তিনি ছপ্পর ফোঁড় করকে আতে হ্যাঁয়-তিনি ছাত ভেঙে আসেন।
একটি কথা, দুটি চাউনি, তাতেই দেহের ক্ষুধা, হৃদয়ের তৃষ্ণা, মনের আকাঙ্ক্ষা সব ঘুচে যায়, সব পরিপূর্ণ হয়ে যায়!
ঘরে ফিরে দেখি সেখানে ভ্রমর গুঞ্জন করছে, পুর্ণিমার চাঁদ উঠেছে, সঙ্গে সঙ্গে আবার রামধনু, তারই নিচে নিয়ে বয়ে যাচ্ছে আমার ছেলেবেলাকার নর্মসখী গ্রামের ছোট নদীটি, এবং সমুখে এক গাদা শিউলি ফুল—সেই প্রথম সন্ধ্যায় শিউলী ফুল-শব্নম শিউলি। আর না, আর না! থামো! থামো! আর আমার সইবে না।
পরদিন সন্ধ্যার সময় যখন আরাম-চেয়ারে শুয়ে শুয়ে ভানুমতীমন্ত্র দিয়ে সেই স্বপ্নকে সঞ্জীবিত করছি এমন সময় ঘরে ঢুকলেন আপাদমস্তক ভারী কালো বোরকায় ঢাকা এক মহিলা।
আমি ভালো করে উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই বোরকা এক ঝটকায় সরে গেল।
শব্নম!
হাত দুখানি এগিয়ে দিলে।
আমি ছুটে গিয়ে তার হাত দুখানি আপন হাতে তুলে নিলুম।
তার পর কাবুলী ধরনে রাজা-বাদশা, গুরু-মুশীদের হাত দুটি যে ভাবে চুমো খাওয়া হয় সেই ভাবে চুমো খেলুম।
বললে, ‘হাটু গাড়ো।’
জো হুকম!
‘বল, “আমি সর্ব হৃদয় দিয়ে সর্বকাল তোমার সেবা করব”।
আমি সর্ব দেহ মন হৃদয় দিয়ে সেবা করব।
খিল খিল করে হেসে উঠল।
ভানুমতীমন্ত্র নিশ্চয়ই মাত্রাধিক করা হয়ে গিয়েছিল। সে মন্ত্রে তো ইন্দ্রজাল সৃষ্টি হয়। এ যে সত্যজাল-না, সত্যের দৃঢ় ভূমি।