কী আত্মপ্রত্যয়! যেন শব্নম এক লহমার তরে আমাদের জন্য তৃষ্ণার জল আনবার জন্য পাশের ঘরে গিয়েছে।
আস্তে আস্তে বললাম, আমার সব চেয়ে বড় দুঃখ তাকে অরুন্ধতী তারা দেখাবার সুযোগ পাই নি বলে। এই যে আমি মজার—ই—শরীফ এলুম গেলুম,—রাত্রিবেলা একবারও আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাতে পারি নি যে কোনও তারা দেখতে পেলেই সব বেদনা আবার এক সঙ্গে আমাকে মুষড়ে ফেলবে বলে।
যে রাতে আমি প্রথম—জ্যোতি পেলুম, তারই আলোকে আমি নির্ভয়ে অরুন্ধতীর দিকে তাকালুম। তিনি আমায় হাসিমুখে বললেন, “স্বর্গে আসতেই দেবতারা আমায় শুধালেন, ‘তুমি কোন পুণ্যলোকে যাবে?’ তাঁরা ভেবেছিলেন, যে—স্বামীর গোপন স্বভাব পদে পদে উভয়কে লাঞ্ছিত করছে সেই কলহাস্পদ স্বামীর কাছে আমি যেতে চাই না। কিন্তু আমি তারই কাছে আছি। তুমি নিজের অসম্পূর্ণতার স্মরণে নিজেকে লাঞ্ছিত করো না। শব্নম আমারই মত তার বৈশিষ্ঠকে খুঁজে নেবে।”
সারা দিনমান কর্তব্যকাৰ্য, নিত্ত্যনৈমিত্তিক সব কিছু করে যেই প্রসন্ন মনে, দাসী যে রকম মুনিব বাড়ির কাজকর্ম করে যায় নিষ্ঠার সঙ্গে, কিন্তু ক্ষণ মন পড়ে থাকে তার আপন কুঁড়েঘরে, আপন শিশুটিকে যেখানে সে রেখে এসেছে—তার দিকে। সন্ধ্যায় ত্বরিত গতিতে যায় সেই শিশুর পানে ধেয়ে—মাতৃস্তনের উচ্ছলিত মুখ সুধারসপীড়িত ব্যাকুল বক্ষ নিয়ে—তার ওষ্ঠাধর নিপীড়নে জননীর সর্বাঙ্গে শিহরণের সঙ্গে সঙ্গে তার মুক্তি, তার আনন্দ—নির্বাণ।
আমিও দিবাবসানে ধেয়ে যাই আমাদের বাসগৃহের নির্জন কোণে। এখানেই আমার জয়, আর এ ঘরেই আমার সর্বস্ব লয়, তাই বহুকাল ধরে এ—ঘরের কথা ভাবতে গেলেই আমার দেহমন বিকল হয়ে যেত। এখন যাই সেই ঘরে, ওই মায়ের চেয়েও তড়িৎ—ত্বরিত বেগে।
বিশ্বকর্মা যখন তিলোত্তমা গড়তে বসেছিলেন তখন সিংহ দিয়েছিল, ক’টি, রম্ভা দিয়েছিল উরু, আর হরিণী যখন দিতে চাইলে তার চোখ, পদ্মকোরকও পেতে চাইলে সেই সম্মান, তখন নাকি বিশ্বকর্মা দুই বস্তুই প্রত্যাখ্যান করে, প্রভাতের শুকতারাকে দুই টুকরো করে গড়েছিলেন তিলোত্তমার দুটি চোখ। শব্নম যখন কান্দাহারে ছিল—
জানেমন্ বললেন, ‘বড় কষ্ট পেয়েছে সে তখন। অত যে কঠিন মেয়ে, সেও তখন ভেঙে পড়ার উপক্রম করেছিল। তারপর বল।’
আমি বললুম, আমাকে তখন বিশ্বকর্মার মত ভূঃ, ভূবঃ, স্বঃ খুঁজে বেড়াতে হয় নি। তাকে স্মরণ করামাত্রই আস্তে আস্তে তার সমস্ত মূর্তি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠত। রাধার ধ্যান ছিল সহজ, কারণ তাঁর কালিয়া ছিলেন কালা, চোখ বন্ধ করা মাত্রই তাকে দেখতে পেতেন—আমার কালা যে গৌরী। কিন্তু বিশ্বকর্মার সঙ্গে আমি তুলনাস্পদ নই। কারণ তার তিলোত্তমা গড়ার সময় তিনি সৃষ্টিকর, চিত্রকর। আমার চারু—সর্বাঙ্গীকে গড়ার সময় আমি তুলি ফটোগ্রাফ। তবে হ্যাঁ, মূর্তি গড়ার সময় আমার সামনে বিলাতী ভাস্করের মত জীবন্ত মডেল থাকত না—খাঁটি ভারতীয় ভাস্করের মত প্রতিমালক্ষণানুযায়ী মূর্তিটি নির্মাণ করে সর্বশেষে তার সম্মিলিত পদযুগলের দুই পদনখকণার উপর ধীরে ধীরে রাখতুম আমার দুই ফোঁটা চোখের জল। এই আমার বুকের হিমিকাকণা—শব্নম।
কিন্তু এবারে আর তা নয়। এবারে অমি মূর্তি গড়ি নে।
এবারে সে আমার মনের মাধুরী, ধ্যানের ধারণা, আত্মনের জ্যোতি।
এবারে আমার আত্মচৈতন্য লোপ পেয়ে কেমন যেন এক সর্বকলুষমুক্ত অখণ্ড সত্তাতে আমি পরিণত হয়ে যাই। কোন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সত্তা সে নয়—অথচ সর্বইন্দ্রিয়ই সেখানে তন্ময় হয়ে আছে। কী করে বোঝাই! সঙ্গীত সমাপ্ত হওয়ার বহু বৎসর পরেও তাকে যখন স্মরণে এনে তার ধ্বনি বিশ্লেষণ করা যায়—এ যেন তারও পরের কথা। রাগিণী, তান, লয়, রস সব ভুলে গিয়ে বাকী থাকে যে মাধুর্য—সেই শুদ্ধ মাধুর্য। অথচ বাস্তব জগতে সেটা হয় ক্ষীণ—এখানে যেন জেগে ওঠে বানের পর বান—গম্ভীর, করুণ, নিস্তব্ধ জ্যোতির্ময় ভূর্ভুবঃস্বঃ।
ওই তো শব্নম, ওই তো শব্নম, ওই তো শব্নম।
৩.৮ শুধু দুটি কথা আমার মনের মধ্যে
শুধু দুটি কথা আমার মনের মধ্যে ক্ষণ জেগে থাকে।
একটি উপনিষদের বাণী :
আকাশ আনন্দপূর্ণ না রহিত যদি
জড়তার নাগপাশে দেহ মন হইত নিশ্চল।
কোহ্যেবান্যাৎ কঃ প্রাণ্যাৎ
যদেষ আকাশো আনন্দে ন স্যাৎ।
আমার প্রথম আনন্দের দিনে হঠাৎ এটি আমার মনের ভিতরে এসেছিল—বহু বৎসর অদর্শনের পর প্রিয়জন আচমকা এসে আবির্ভূত হলে যে রকম হয়। তাকে কোথায় বসাব, কী দিয়ে আদর করব কিছুই ঠিক করে উঠতে পারি নি। এই যে আকাশ বাতাস, সে আনন্দে পরিপূর্ণ না থাকলে, কে একটি মাত্র নিশ্বাস নিতে পারত এর থেকে?
সেই রাত্রে আমি আমাদের বাসরঘরে যাই। শব্নম যেদিন চলে যায়, সেদিন কেন জানি নে তার কুরান—শরীফখানা টেবিলের উপর রেখে গিয়েছিল।
প্রত্যাদেশের সন্ধানে অনেকেই কুরান খুলে যেখানে খুশি সেখানে পড়ে। আমার কোনও প্রত্যাদেশের প্রয়োজন নেই। আমি এমনি খুলেছিলুম।
‘ওয়া লাওয়া ফদ্লুল্লাহি আলাইকুম ও রহ্মমতহু ফী দ্দুনিয়া ওয়াল আখিরা—’
‘ভূলোক দ্যুলোক যদি তাঁর দাক্ষিণ্য ও করুণায় পরিপূর্ণ না থাকত তবে—’ তবে? সর্বকালের মানুষ সর্ব বিভীষিকা দেখেছে। তার নির্যাস মানুষের—অসম্পূর্ণতা তখন রুন্দ্রের বহ্নি (গজব) আহ্বান করে আনত, সৃষ্টি লোপ পেত।
মনে পড়ল, ছেলেবেলাকার কথা। দাদারা ইস্কুলে, আমার সে বয়স হয় নি। দুপুর বেলা মা আমাকে চওড়া লালপেড়ে ধুতি, তাঁরই হাতেবোনা লেসের হাতাওয়ালা কুর্তা, আর জরির টুপি পরিয়ে সামনে বসিয়ে কুরান পড়ত। এই জ্যোতি অনুচ্ছেদটিই মার বিশেষ প্রিয় ছিল—বহু বহু বিশ্বাসীর তাই। আমার স্মরণে ছিল শুধু দুটি শব্দ ‘ফদল’ আর ‘রহমৎ’—উচ্ছ্বসিত দাক্ষিণ্য ও করুণা। তখন শব্দ দুটির অর্থ বা অন্য কোন কিছু বুঝি নি। আজও কি সম্পূর্ণ বুঝেছি?