“দুঃখ, তব যন্ত্রণায় যে দুর্দিনে চিত্ত উঠে ভরি,
দেহে মনে চতুর্দিকে তোমার প্রহরী
রোধ করে বাহিরের সান্ত্বনার দ্বার,
সেই ক্ষণে প্রাণ আপনার
নিগূঢ় ভাণ্ডার হতে গভীর সান্ত্বনা
বাহির করিয়া আনে; অমৃতের কণা
গ’লে আসে অশ্রুজলে;
সে আনন্দ দেখা দেয় অন্তরের তলে
যে আপন পরিপূর্ণতায়
আপন করিয়া লয় দুঃখবেদনায়।”
সঙ্গে সঙ্গে এক অবর্ণনীয় আনন্দ—মধুরিমা আমার সর্বদেহ—মনে ব্যাপ্ত করে দিল এবং সঙ্গে সঙ্গেই মনে পড়ে গেল, পরীক্ষা পাশের জন্য মুখস্থ করা বিদ্যের একটা অংশ—সেটা তখন বুঝি নি, এখন সুগন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে সেটা জ্বলজ্বল করে চোখের সামনে ভেসে উঠল।
রাজপুত্র দারা শ্রীকূহ্—কৃত উপনিষদের ফার্সী অনুবাদ তো আপনি পড়েছেন, কিন্তু সব উপনিষদ অনুবাদ করেন নি বলে বলতে পারব না বৃহদারণ্যক তাতে আছে কি না। তারই এক জায়গায় আমাদের দেশের এক দার্শনিক রাজা জনক গেছেন ঋষি যাজ্ঞবক্ল্যের কাছে। ঋষিকে শুধালেন, “যাজ্ঞবল্ক্য, মানুষের জ্যোতি কি—অর্থাৎ তার বেঁচে থাকা, তার কাজকর্ম ঘোরাফেরা করা কিসের সাহায্যে হয়—কিংজ্যোতিরয়ং পুরুষ:?”
যাজ্ঞবল্ক্য বললেন, “সূর্য।”
জনক শুধালেন, “সূর্য অস্ত গেলে?—অস্তমিত আদিত্যে?”
“চন্দ্রমা।”
“সূর্য চন্দ্র উভয়েই অস্ত গেলে—অস্তমিত আদিত্য, যাজ্ঞবাল্ক্য, চন্দ্রমস্যস্তমিতে কিংজ্যোতিরেবায়ং পুরুষ:?”
“অগ্নি।”
“অগ্নিও যখন নির্বাপিত হয়?”
“বাক্—ধ্বনি। তাই যখন অন্ধকারে সে নিজের হাত পর্যন্ত ভাল করে দেখতে পায় না, তখন যেখান থেকে কোন শব্দ আসে, মানুষ সেখানে উপনীত হয়।”
এইবারে শেষ প্রশ্ন।
জনক শুধালেন, “সূর্য চন্দ্র গেছে, আগুন নিবেছে, নৈঃশব্দ্য বিরাজমান—তখন পুরুষের জ্যোতি কী?” সংস্কৃতটি ভারী সুন্দর, পদ্য ছন্দে যেন কবিতা। “অস্তমিত আদিত্যে, যাজ্ঞবল্ক্য, চন্দ্রমস্যস্তমিতে, শান্তেহগ্নৌ, শান্তায়াৎ বাচি, কিংজ্যোতিরেবায়ং পুরুষ?”
যাজ্ঞবল্ক্য শেষ উত্তর দিলেন, “আত্মা।”
আমাদের কবির ভাষায় ‘অন্তরের অন্তরতম পরিপূর্ণ আনন্দকণা।” আরবী ফারসী উর্দুকে যাকে আমরা বলি ‘রূহ’। এসব তো আপনি ভাল করেই জানেন।
আমার ধোঁকা লাগল অন্যখানে। যাজ্ঞবল্ক্য যখন চেনা জিনিস সূর্য থেকে আরম্ভ করে জনককে অজানা আত্মাতে নিয়ে যাচ্ছেন তখন ‘অগ্নি’কে জ্যোতি বলার পর তিনি ‘গন্ধ’কে মানুষের জ্যোতি বললেন না কেন? গন্ধ তো শব্দের চেয়ে অনেক বেশী দূরগামী। কোথায় রামগিরি আর কোথায় অলকা—কোথায় নাগপুর আর কোথায় কৈলাশ—সেই রামগিরি—শিখরে দাঁড়িয়ে বিরহী যক্ষ দক্ষিণগামী বাতাসকে আলিঙ্গন করেছিলেন। সেই বাতাসে হিমালয়ের দেবদারু গাছের গন্ধ পেয়েছিলেন, হয়তো এই বাতাসই তাঁর অলকাবাসী প্রিয়াঙ্গীর সর্বাঙ্গ চুম্বন করে এসেছে;
“হয়ত তোমারে সে পরশ করি আসে,
হে প্রিয়া মনে মনে ভাবিয়া তাই
সকল অঙ্গেতে সে বায়ু মাখি লয়ে
পরশ তব যেন তাহাতে পাই।”
ফার্সী এবং সংস্কৃত ছন্দে প্রচুর মিল আছে। জানেমন্ তাই আমাকে একাধিকবার মূল সংস্কৃতটা আবৃত্তি করতে বললেন।
ভিত্ত্বা সদ্যঃ কিশলয়পুটান্ দেবদারুদ্রুমণাং
যে তৎক্ষীরস্রুতিসুরভোয়ে দক্ষিণেন প্রবৃত্তাঃ।
আলিঙ্গ্যন্তে গুণবতি ময়া তে তুষারাদ্ৰিবাতাঃ
পূর্ব স্পৃষ্টং যদি কিল ভবেদঙ্গমেভিস্তবেতি।
আমি ভেবেছিলুম, এই খেই ধরে কাব্যালোচনাই চলবে, কিন্তু জানেমন্ই বললেন, ‘গন্ধের কথা বলছিলে।’
আমি বললুম, ‘জী। আর যক্ষের সুবাসানুরাগ না হয় কবিত্ব বলে উড়িয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু আমি এমন গন্ধকাতর লোক দেখেছি, যে বেহারে দক্ষিণমুখো হয়ে দাঁড়িয়ে বাতাসের গন্ধ নিতে আমাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে বাতাসে বাংলা সাগরের নোনা গন্ধ—স্পর্শ। এটা কল্পনা নয়।’
তা সে যা—ই হোক, ঋষি গন্ধকে জ্যোতিরূপে বাকের চেয়ে ন্যূনতর মনে করেছেন, কারণ শব্দের সাহায্যে আমরা অন্ধকারে যে দিগ্দর্শন পেয়ে উৎপত্তিস্থলে পৌঁছতে পারি বাস দিয়ে অতখানি পারি নে, কিংবা হয়তো স্বীকার করেও সংক্ষেপ করেছেন—যেমন স্পর্শের কথাও বলেন নি।
কিন্তু আসল কথা এই একটুখানি সৌরভেই আমি যদি মুহ্যমান, অভিভূত হয়ে যাই তবে তার পরের সোপান এবং সেটা তো সোপান নয়, সে তো মঞ্জিল, সেই তো সাগরসঙ্গম, সেই তো আত্মন—সে তো দূরে নয়, কঠিন নয়। সেই তো একমাত্র অনির্বাণ জ্যোতি, সেই তো নূর, ব্ৰহ্ম। সেই আলোতেই আমি অহরহ শব্নমকে দেখতে পাব। সূর্য যখন অস্তমিত, অগ্নি যখন শান্ত তখন যদি শব্নম সুরভিবাস দিয়ে আমাকে পঞ্চেন্দ্ৰিয়াতীত করে দিতে পারে তবে আর এইটুকুতে নিরাশ হবার কিছুই নেই। বিশ্বাস করা কঠিন, তখন সে জ্যোতি আমি পেলুম আমার অন্তরেই।
আমি চুপ করলুম। জানেমন্ বললেন, এতে অবিশ্বাসের তো কিছুই নেই। আমি যেটুকু পেয়েছি, সেটুকু চোখের আলো হারানোর শোকে এবং আপন অন্তর থেকেই, বহু সাধনার পর। তুমি পেয়ে গেলে অল্প বয়সেই সে শুধু পিতৃপুরুষের আশীর্বাদের ফলে।
আমি বাধা দিয়ে বললুম, ‘কিন্তু চিরস্থায়ী নয় আমার এ সম্পদ। মাঝে মাঝে—’
জানেমন্ আমাকে কাছে টেনে এনে আমার মাথা তাঁর কোলের উপর রেখে হাত বুলোতে বুলাতে বললেন, আমারও তাই। আমাদের বন্ধু সুফী সাহেবেরও তাই। তার পর বল। আমার শুনতে বড় ভাল লাগছে। শব্নম ফিরে এলে তার সামনে আবার তুমি সব বলবে।