দেখি, তাঁর চোখ দুটি দিয়ে অল্প অল্প রক্তক্ষরণ হচ্ছে।
একবার দেখেছি, একবারের কথা শুনেছি-এই তৃতীয়বার। এর পর আজ পর্যন্ত আর কখনও দেখি নি।
আমি আকুল হয়ে তাকে দুই বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরলুম। তাঁর চোখ মুছে দিতে দিতে মনে মনে শব্নমকে উদ্দেশ্য করে বললুম, ‘হিমি, বিরহ-ব্যথায় যে আঁখি বারি ঝরে সেটা শুকিয়ে যায়—প্রিয়-মিলনের সময় সেটা দেখানো যায় না। দেখাতে হলে সেটা বুকে করে বইতে হয়। তুমি যেদিন ফিরে আসবে সেদিন এই রক্তচিহ্ন দেখিয়ে তোমাকে বলব, ‘জানেমন্ তোমার জন্য তার বুকের ভিতর কী রকম রক্তরেখায় পদ্ম-আসন প্রস্তুত করে রেখেছিলেন, দেখ।’
আমি জানেমন্কে চুম্বন দিতে দিতে বললুম, আপনি শান্ত হোন। আপনি জানেন না, আমার হৃদয় এখন শান্ত।
আমি জানতুম, জানেমন্ শব্নম উভয়ই-অন্তত ক্ষণেকে তার শোক ভুলে যান- ঋষিকবিদের বাণী শুনতে পেলে। বললুম, ‘আপনি সোক্রাতের যে কথা উল্লেখ করলেন, সেই বলেছেন, আমাদের কবি আবদুর রহীমন্ খান-ই-খানান-
“রহীমন! তুমি বলো না লইতে অনাদরে দেওয়া সুধা-
আদর করিয়া বিষ দিলে কেহ মরিয়া মিটাব ক্ষুধা।”
“রহীমন! হমে না সুহায় আমি পিয়াওৎ মান বিন।
জো বিষ দেয় বেলায় মান সহিত মরিব ভালো।।”
আমাকে, আরও কাছে টেনে এনে বললেন, সুদর! সুন্দর। সুন্দর! দাঁড়াও, আমি ফার্সীতে অনুবাদ করি; মুখে মুখেই বললেন,
“আয় রহীমন, না গো মরা—”
৩.৭ অনেকক্ষণ যেন ধ্যানে মগ্ন থেকে
অনেকক্ষণ যেন ধ্যানে মগ্ন থেকে আমাকে শুধালেন, তুমি পেয়েছ? কী পেয়েছ?
‘সে কি আমি নিজেই ভাল করে বুঝতে পেরেছি যে আপনাকে বুঝিয়ে বর। এর সাধনা তো আমৃত্যু, কিংবা হয়তো মৃত্যুর পরক্ষণেই বুঝব এতদিন শুধু বইয়ের মলাটখানাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেছি, বইটার নাম পড়েই ভেবেছি ওর বিষয়?’ আমার জানা হয়ে গিয়েছে, তখন দেখব এতদিন কিছুই বুঝতে পারি নি। শব্নমই আমাকে একদিন বলেছিল, সামান্য একটু আলাদা জিনিস:—
“গোড়া আর শেষ, এই সৃষ্টির
জানা আছে, বল কার?
প্রাচীন এ পুঁথি, গোড়া আর শেষ
পাতা কটি ঝরা তার?”
হিরন্ময় পাত্রের দিকে তাকিয়েই মুগ্ধ হৃদয়ে কেটে গিয়েছে সমস্ত জীবন—ওর ভিতরকার সত্যটি দেখতে পাই নি। বিকলবুদ্ধি শিশুর মত এতদিন চুষেছি চুষিকাঠি—এইবারে প্রেম মাতৃস্তন্যের অনাদি অতীত প্রবহমান সুধা—ধারা। সেই যে শিশুহারা মা তার বাচ্চাকে কাঁদতে কাঁদতে খুঁজেছিল আকাশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত অবধি—চলার পথে ঝরে পড়েছিল তার মাতৃস্তন্যরস তাই দিয়েই তো দেবতারা তৈরি করলে, মিলকিওয়ে—আকাশগঙ্গার ছায়াপথ।
‘এ জীবনেই তো পৌঁছই নি পাহাড় চূড়োয়, যেখান থেকে উপত্যকার পানে তাকিয়ে বলতে পারব, এই যে উপত্যকার কাঁটাবন খানাখন্দ, কাদা—পাথর, সাপ-জোঁকে ক্ষতবিক্ষত চরণে এখানে এসে পৌঁছেছি—এই উপত্যকাই কত সুন্দর দেখায় গিরিবাসিদের কাছে, যারা কখনও উপত্যকায় নামে নি—আমি কিছুটা উপরে এসেছি মাত্র, আর এর মধ্যেই কাঁটাবনকে নর্মকুঞ্জ বলে মনে হচ্ছে, কাদা—ভরা খালকে প্রাণদায়িনী স্রোতস্বিনী বলে মনে হচ্ছে। গিরি—শিখরে পৌঁছলে সমস্ত ভুবন মধুময় বলে মনে হবে, এই আশা ধরি।
জানেমন্ স্মিতহাস্যে বললেন, ‘বুঝেছি, কিন্তু এইটুকুই পেলে কী করে?’
আমি বললুম, ‘অদ্ভুত, সেও আশ্চর্য! মনে আছে, মাসখানেক আগে সখী এসেছিল শব্নমের। ওর সঙ্গে দমকা হাওয়ার মত এল শব্নমের আতরের গন্ধ। গোয়ালিয়র না কোথা থেকে শব্নম আনিয়েছিল যে এক অজানা আতর, তারই সবটা দিয়ে দিয়েছিল তার সখীকে—মাত্র একদিন ওইটে মেখে এসেছিল আমার—আমাদের—না, আমাদের সক্কলের বাড়িতে আমাদের প্রথম বিয়ের দিনে—’
সে কী?
অজানতে বলে ফেলেছি। ভালই করেছি। আরও আগেই বলা উচিত ছিল।
কী আনন্দ আর পরিতৃপ্তির সঙ্গে বৃদ্ধ যোগী শুনলেন আমাদের বিয়ের কাহিনী। হাসবেন, না, কাঁদবেন কিছুই যেন ঠিক করতে পারছেন না। খানাতে দোম্বা না মুর্গীর বিরিয়ানী ছিল সেও তাঁর শোনা চাই, তোপলের স্ত্রীধন নিয়ে আহাম্মুকির কথা ভাল জানা চাই। এক কথা দশবার শুনেও তাঁর মন ভরে না। আর বার বার বলেন, ওই তো আমার শব্নম। কী যে বল গওহর শাদ, কোথায় নুরজাহান!
কতদিন হয়ে গিয়েছে, কিন্তু এখনও তাঁর পরম মুখ—রোচক মজলিশের জৌলুস—আমাদের এই প্রথম বিয়ের কাহিনী।
শেষটায় শেষ প্রশ্ন শুধালেন, আচ্ছা, বিয়ের পর তোমাতে ওতে যখন প্রথম একলা—একলি হলে তখন সে প্রসন্ন হাসি হাসলে, না কাঁদলে?
আমার লজ্জা পাচ্ছিল, বললুম, কাঁদলে।
‘জানতুম, জানতুম। অমারই স্মরণে কেঁদেছিল।’ এবারে মুখে পরিতৃপ্তির উপর বিজয়—হাস্য। বললেন, এইটুকুনই জানতে চেয়েছিলুম। এইবারে বল, তোমার সেই আতরের কথা।
‘চেনা দিনের ভোলা গন্ধের আচমকা চড় খেয়েছিলাম, সেদিন। এর পূর্বে আমি জানতুম না, স্মৃতির অন্ধকার ঘরে সুগন্ধ আলোর চেয়েও সতেজ হয়ে মানুষকে কতখানি অভিভূত করতে পারে। আমি অনেকখানি মুহ্যমান হয়ে ওই সুবাস বন্যায় যেন ভেসে চলে গিয়েছিলুম। আপনাদের মধ্যে নিশ্চয়ই—প্রীতিসম্ভাষণ দান—প্রদান হয়েছিল—আমি কিছুই শুনতে পাই নি।
এইখানেই আরম্ভ।
শব্নম একদিন আমায় শুধিয়েছিল, “যখন সব সান্ত্বনার পথ বন্ধ হয়ে যায় তখন হৃদয় হঠাৎ এক আনন্দলোকের সন্ধান পায়”—এটা আমি জানি, কি না? আমি উত্তর দেবার সুযোগ পাই নি। আমাদের যে কবির এদেশে আসার কথা ছিল, তিনি ছন্দে বলেছেন,