লোকে হাসবে, বলবে, এই যে লোকটা মজনূঁর মত পাগলপারা খুঁজেছে তার লায়লীকে, ঘূর্ণিবায়ু হয়ে প্রতি উটের মহমিলে, প্রতি সরাইয়ে, মজারে-কান্দাহারে খুঁজেছে তার শব্নমকে, দুদিন আগে-সে কিনা আজই হেসে খেলে বেড়াচ্ছে।
তাই হোক, সেই আমার কাম্য।
শব্নম বলেছিল তুমি আমার বিরহে অভ্যস্ত হয়ে যেয়ো না।
অভ্যস্ত সবাই হয়, আমিও হব, তাতে আর কী সন্দেহ?
ধর্মনিষ্ঠ অথচ বিত্তশালী এক গোস্বামীকে তাঁর স্ত্রী হঠাৎ এসে একদিন কাঁদতে কাঁদতে দুসংবাদ দিলেন, তাঁদের নায়েব বিশ্বাসঘাতকতা করে তাদের সর্বস্ব অপহরণ করেছে। কালই তাঁদের রাস্তায় বসতে হবে। গৃহিণীর মুখের দিকে একটুখানি তাকিয়ে গোস্বামী আবার পুঁথিপাঠে মন দিলেন। তিনি কেঁদে বললেন, ওগো, তুমি যে কিছুই ভাবছ না, আমাদের কি হবে।
গোস্বামী পুঁথি বন্ধ করে, হেসে বললেন, ‘মুগ্ধে, আজ থেকে বিশ কিংবা ত্রিশ বৎসর পরে তুমি এই নিয়ে কান্নাকাটি করবে না। তোমার যে অভ্যাস হতে ত্রিশ বৎসর লাগবে আমি সেটা তিন মুহূর্তেই সেরে নিয়েছি।’
আমি ওই গোস্বামীর মত হব।
তিন লহমায় গোস্বামী অভ্যস্ত হয়ে গেলেন এর রহস্যটা কী?
রহস্য আর কিছুই নয়। গোস্বামী শুধু একটু স্মরণ করে নিলেন, বিত্ত যেমন হঠাৎ যায়, তেমনি তার চেয়েও হঠাৎ ফিরে আসতে পারে। আরও হয়তো অনেক তত্ত্বকথা ভেবে নিয়েছিলেন, যথা, বিত্তনাশ সর্বনাশ নয়, বিত্তাবিত্ত সবই মায়া—কিন্তু ওসবে আমার প্রয়োজন নেই। প্রথম আগত প্রথম কারণই যথেষ্ট।
তার চেয়েও বড় কথা—শব্নম আমার সাধারণ ধনজনের মত বিত্ত নয়। সে কী, সে কথা এখনও বলতেও পাব না। সাধনা করে তা উপলদ্ধির ধন।
স্বীকার করছি, জ্ঞানী গোস্বামরি মত তিন লহমায় আমি সে জিনিস পাই নি। সব জেনে-শুনেও আমাকে অনেক ফোঁটা চোখের জল ফেলতে হয়েছে—না ফেলতে পেরে কষ্ট হয়েছে তারও বেশী। পাগল হতে হতে ফিরে এসেছি, সে শুধু শব্নমের কল্যাণে। পরীর প্রেমে মানুষ পাগল হয়। পরী মানে কল্পনার জিনিস। কিংবা বলব, প্রত্যেক রমণীর ভিতরই কিছুটা পরী লুকিয়ে থাকে। সেটাকে ভালবাসলেই সর্বনাশ। পুরুষ তখন পাগল হয়ে যায়। শব্নমের পরীর খাদ ছিল না। আমি পাগল হয়ে গেলে শব্নমের বদনামের অন্ত থাকতো না।
আবার বলছি, তিন লহমায় আমি সে জিনিস পাই নি। ভালই হয়েছে। গোস্বামী হয়তো তিন লহমায় বিশ বৎসরের পুঞ্জীভূত যন্ত্রণা এক ধাক্কায় সয়ে নেবার মত শক্তি ধরেন। আমার কি সে শক্তি আছে!
আমি সাধারণ বিরহ-বেদনার কথা বলছি না। পায়ের শব্দ শুনে সে বুঝি এসেছে ভাবা, ঘোড়ার গাড়ি বাড়ির সামনে দাঁড়াতে সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বার বার নিরাশ হওয়া, কারও হাতে কোনও চিঠি দেখলেই সেটা শব্নমের মনে করা, বাড়ি থেকে বেরুতে না পারা-হঠাৎ যদি সে এসে যায় সেই আশায়, আবার না-বেরুতে পেরে তার সন্ধান করতে পারছি নে বলে যন্ত্রণা ভোগ, যে আসে তার মুখেই বিষাদ দেখে হঠাৎ রেগে ওঠা, এবং পরে তার জন্য নিজেকে শাস্তি দেওয়া—এ তো সকলেরই জানা। যে জানে না, সে-লোকের সঙ্গে আমার যেন কখনও দেখা না হয়। সে সুখী?
জানেমন্ বয়েৎ বলতে বলেত এমন একটি কান্দাহারী শব্দ ব্যবহার করলেন যেটি ইতিপূর্বে আমি মাত্র একবার শব্নমেরই মুখে শুনেছি। সঙ্গে সঙ্গে আমার সর্ব চৈতন্য যেন লোপ পেল। কে যেন আমার মাথায় ডাঙশ মারলে—প্রথমটায় লাগে নি, তার পর হঠাৎ অসহ বেদনা, তার পর অতি ধীরে ধীরে সেটা কমল। ডাঙশ যেন চোখে-চোখে আমার যন্ত্রণাবোধটা উপভোগ করলে। এ তো সকলেরই হয়। এ আর নূতন করে কীই বা বলব?
জানেমন্ এখন কথা বলেন আরও কম। শব্নমের কথা আমিই তুলে অনুযোগ করলুম। এখন আমার সামনে তার কথা আর কেউ তোলে না—পাছে আমার লাগে, বোঝে না, তাতে আমি ব্যথা পাই আরও বেশী—তাই আমাকেই তুলতে হবে তার কথা।
আমার হাত দুখানি তাঁর কোলে নিয়ে বললেন, ‘বাচ্ছা, শব্নম আমাকে দুঃখ দেবে কেন? আর দুঃখ যদি পেতেই হয়, তবে তার হাতেই যেন পাই। যে বন্দীখানায় সোক্রাৎকে (সোক্রাতেস) জহর খেতে হয়েছিল তার কর্তা ছিলেন তারই এক শিষ্য এবং বিষপাত্র সোক্রাৎকে এগিয়ে দেওয়া ছিল তারই কাজ। পাত্র আনবার পূর্বে তিনি কেঁদে বলেছিলেন, “প্রভু, আমাকেই করতে হবে এই কাজ?” সোক্ৰাৎ পরম সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘আহা! সেই তো আনন্দ। না হলে যে ব্যক্তি আমার মৃত্যু কামনা করে সে যখন জিঘাংসাভরে পৈশাচিক আনন্দের হাসি হেসে আমার দিকে বিষভাণ্ড এগিয়ে দেয় সেটা তো সত্যই পীড়াদায়ক।’ এই বেদনার পেয়ালা ভরা আছে শব্নমের আঁখি বারিতে-’
আমার বুকে আবার ডাঙশ। সেখানে যেন বিদ্যুৎ-বিভাসে ধ্বন্যালোক হয়ে ফুটে উঠল শব্নম। তার দুঃখের মুহূর্তে আমাকে একদিন বলেছিল, ‘কত আঁখিপল্লব নিংড়ে নিংড়ে বের করা আমার এই এক ফোটা আঁখিবারি।’ হায় রে কিস্মৎ! দুঃখের দিনেই তুমি বদ্-কিম্মতের স্মৃতিশক্তি প্রখর করে দাও!
শুনছি, জানেমন্ বলে যাচ্ছেন সেই ভাল সেই ভাল। ধীরে ধীরে আকাশের দিকে দুই বাহু প্রসারিত করে অজানার উদ্দেশে বললেন, ‘সেই ভাল, হে কঠোর, হে নির্মম! একদিন তুমি আমার চোখের জ্যোতি কেড়ে নিয়েছিলে—আমি অনুযোগ করেছিলুম। তারপর শব্নমরূপে সেটা তুমি ফেরত দিলে শতগুণ জ্যোতির্ময় করে—আমি তোমার চরণে লুটিয়ে জন্মদাসের মত বার বার তোমার পদচুম্বন করি নি? আজ যদি তুমি আবার সেই জ্যোতি কেড়ে নিতে চাও তো নাও—আমি অনুযোগ করব না, ধন্যবাদও দেব না। কিন্তু এই হতভাগ্য পরদেশী কী করেছিল, আমায় বল, তাকে তুমি-’