তার উপর সূফী সাহ্বে বুড়োর মুরশীদ বা গুরু।
শুনলুম, আমানুল্লা কর্তৃক ফ্রান্সে নির্বাসিত তাঁর সিপাহসলার বা প্রধান সেনাপতি নাদির খান বাচ্চাকে তাড়াবার জন্য গজনী পর্যন্ত পৌঁছে গেছেন। রঙরুটের অপেক্ষা না করে কান্দাহারেই আবদুর রহমান তাঁর সৈন্যদলে ঢুকেছে।
শব্নমের কাছে শুনেছিলুম, ফ্রান্সের নির্বাসনে আমার শ্বশুরমশাই আর নাদির খানে তাঁদের পূর্বপরিচয় গভীরতর হয়েছিল। বহু যুগের পারিবারিক দ্বন্দ্ব ছিল বলেই একদিন যখন হঠাৎ মৈত্রী স্থাপিত হল তখন সেটা গভীরতম বন্ধুত্বের রূপ নিল। ফ্রান্সে সব মেয়েরই একটি করে গড-ফাদার থাকে, শব্নমের ছিল না বলে দুঃখ করতে নাদির নিজে যেচে তার গড-ফাদার হবার সম্মান লাভ করেছিলেন-শব্নম বলেছিল। তবু আমার শ্বশুর আমানুল্লা আফগানিস্থান ত্যাগ না করা পর্যন্ত নাদিরের অভিযানে যোগ দেন নি।
আমার ভয় হল, বাচ্চা যদি জানেমনের উপর দাদ নেয়!
কুহ-ই-দামন, জবল্-উস্-সিরাজ অঞ্চল পেরবার সময় দেখি বাচ্চার সঙ্গী ডাকাতরা তাকে ডেজার্ট করে পালাচ্ছে। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য! অত্যাচারী মাস্টারের নিপীড়নে যখন নিরীহ শিশু ভ্যাক করে কেঁদে ফেলে তখন করুণা হয়, কিন্তু সেই স্যাডিস্ট মাস্টার যখন হেডমাস্টারের হুড়ো খেয়ে কেঁচোটি হয়ে যান তখন ঘেন্না ধরে, হাসি পায়। নিরীহ বাছুরের দুশমন শূয়োরকে বাঘ তাড়া লাগালে যেমন মনটা প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। রাস্তার উপরে, এদিকে ওদিকে ছড়ানো তাদের পরিত্যক্ত লুটের মাল, দামী দামী রাইফেল। নাদির-বাঘ আসছে, ওগুলো কুড়োবার সাহস কারও নেই। শুনেছি কোনও শান্ত জনপদবাসী নাকি নিরপরাধ প্রশ্ন শুধিয়েছিল এক পলায়মান ডাকাতকে, সে কোন্ দিকে যাচ্ছে, আর অমনি নাকি ডাকাত বন্দুক ফেলে নিরস্ত্র পথচারীর পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিল। ঐতিহাসিক খাফী খান তাহলে বোধ হয় খুব বেশী বাড়িয়ে বলেন নি যে, আবদালী দিল্লি আসছে শুনে মারাঠা সৈন্যরা নাকি ‘আইমা’ ‘কাইমা’—অর্থাৎ মায়ের স্মরণে চিৎকার করতে করতে যখন দিল্লী থেকে পালাচ্ছিল তখন নাকি শহরের রাঢ়ীবুড়ীরাও ধমক দিয়ে ওদের নিরস্ত্র করে মালপত্র কেড়ে নিয়েছিল।
বিজয়ী নাদীর কাবুলে প্রবেশ করলেন নগরীর পশ্চিম দ্বার দিয়ে। পরাজিত আমি উত্তর দ্বার দিয়ে।
৩.৬ কত মাস, কত বৎসর কেটে গিয়েছে
কত মাস, কত বৎসর কেটে গিয়েছে কে জানে!
বাদশা এবং আমার শ্বশুরও হার মেনেছেন।
সে নেই, একথা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারব না। নিশ্চিহ্ন নিরুদ্দেশ হয়ে প্রত্যাবর্তন করার উদাহরণ ইতিহাসে বিরল নয়। তার চেয়ে বরঞ্চ নির্দয়তর সন্দেহই মেনে নেব—আমার প্রেমে কোনও অপরিপূর্ণতা ছিল বলেই শব্নম অন্তরালে বসে প্রতীক্ষা করছে, কবে আমি তাকে গ্রহণ করার জন্য উপযুক্ত হব, কবে আমার বিরহ-বেদনা বিদ্ধ সরোবর নিস্তরঙ্গ প্রশান্ত হবে সেই শব্নম কমলিনীকে তার বক্ষে প্রস্ফুটিত করার জন্য।
নিশ্চয়ই আমার প্রেমে কোনও অপরিপূর্ণতা আছে।
শব্নমকেই-একদিন সংস্কৃতে শুনিয়েছিলুম, শত্রু বেদনা দেয় মিলনে, মিত্র দেয় বিরহে—শত্রু মিত্রে তা হলে পার্থক্য কোথায়? অথচ মিত্র যখন দূরে চলে যায় সে তো প্রিয়জনকে বেদনা দেবার জন্য যায় না। তবে কেন হাসিমুখে তাকে বিদায় দিতে পারি নে, তবে কেন হাসিমুখে তার পূনর্মিলনের জন্য প্রতীক্ষা করতে পারি নে-শব্নম যে রকম কান্দাহারে স্লান মুখে, বিষন্নবদনে সন্ধ্যাদীপ জ্বালত সে রকম না, উজ্জ্বল প্রদীপ, উজ্জ্বল মুখ নিয়ে।
সূফী সাহেবও তো ওই কথাই বলেছিলেন—অন্যপ্রসঙ্গে। বলেছিলেন, প্রতিবার যোগাভ্যাসের পর দেহ-মন যেন প্রফুল্লতর বলে বোধ হয়, না হলে বুঝতে হবে অভ্যাসের কোনও স্থলে ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে। প্রেমযোগেও নিশ্চয়ই তা হলে একই সত্য। সে যোগ, সে মিলনের পর যখন প্রিয়-বিচ্ছেদ আসে তখন আমার হৃদয় থেকে কাতর-ক্রন্দন বেরুবে কেন? আমি কেন হাসিমুখে মুহুর্মুহু বিরহ-দিনান্তের পানে তাকাতে পারব না, সেই দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে যে, সময় হলে পূর্ণচন্দ্রের উদয় হবেই হবে। আমি কি মুর্খ যে দাহন-বেলায় ইন্দুলেখা কামনা করব? আমি হব সমাহিত জ্যোতিষীর ন্যায়, যে সূর্যাগ্রাসের সময় বর্বরের মত সূর্য চিরতরে লোপ পেল ভয়ে বিকট অট্টরব করে ওঠে না। অবলুপ্ত মধ্যাহ্ন সূর্য তখন বিরাজ করেন তার জ্ঞানাকাশে। শব্নম আমারই বুকের মাঝে চন্দ্রমা হয়ে নিত্য তো রাজে। শব্নম-শিশিরকুমারী প্রাতে যদি অন্তর্ধান হয়ে থাকে তবে কি আজ সন্ধ্যায় পুনরায় সে আমার শুষ্কাধরে সিঞ্চিত হবে না?
আমি কেন হাসিমুখ দেখাব না? আমি কি শ্মশানে বৈরাগ্য বিলাসী নন্দী-ভৃঙ্গী যে দারিদ্র্যের উগ্র দর্পে ত্রিভুবন শঙ্কাম্বিত করব? আমার মৃত্যুঞ্জয় প্রেমের সঙ্গে হরিহরাত্মা আমিও মৃতুঞ্জয়—মধুমাসে আমার মিলনের লগ্ন আসবে, আমার ভালে তখন পুষ্পরেণু, বিরহ-দিগম্বর তখন প্রাতঃসূর্যরুচি রক্তাংশুক পরিধান করবে। না। আমি এখনই, এই মুহুর্তেই বরবেশ ধারণ করব-বিরহের অস্থিমালা চিতাভষ্ম আমি এই শুভলগ্নেই ত্যাগ করলুম, আমার প্রতি মুহুতই শুভমুহূর্ত।
খৃষ্ট কি বলেন নি, উপবাস করলে ভণ্ডতপস্বীর মত শুষ্কমুখ নিয়ে দেখা দিয়ো না। তারা চায়, লোকে জানুক, তারা পুণ্যশীল। তুমি বেরুবে প্রসাধন করে, তৈলস্নিগ্ধ মস্তকে।