তঙ্গ-দস্তীমে কৌন কিসকা সাত দেতা হৈ?
কি তরিকীমেন্নঁ সায়াভী জুদা হোতা হৈ ইনসাঁসে!
আমার নিজের সামান্য জ্ঞান, কাবুলে ফরাসী রাজদূতাবাসের প্রত্নতাত্ত্বিক যিনি জালালাবাদ-গান্ধার এবং বামিয়ানে খোঁড়াখুঁড়ি করে শত শত ক্ষুদ্র বহৎ অনিন্দ্যসুন্দর বুদ্ধমূর্তি বের করেছিলেন-তাঁর দিনে দিনে দেওয়া অসংখ্য তথ্য ও তত্ত্বজ্ঞান, আমার কোনও কাজেই লাগল না।
কাজে লাগল সে এক সম্পূর্ণ অন্য জিনিস।
কাবুল ছেড়ে আসার পর, হিন্দুকুশের চড়াই তখনও আরম্ভ হয় নি, এমন সময় বেশ কিছুক্ষণ ধরে ক্ষণে ক্ষণে আমার সেই আচ্ছন্ন অবস্থার ভিতরও আমার মনে হতে লাগল, এ জায়গায় আমি যেন পূর্বেও একবার, কিংবা একাধিকবার এসেছি। এ রকম অভিজ্ঞতা নাকি সকলের জীবনেই হয়—কেমন যেন স্বপ্নে না জাগরণে দেখা, আধচেনা-আধভোলা একটা জায়গা বা পরিবেষ্টনী এমন ভাবে সামনে এসে উপস্থিত হয় যে মানুষ পথে যেতে যেতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় আর ভাবে, সামনের মোড় নেওয়া মাত্রই একেবারে সম্পূর্ণ এক চেনা জায়গায় এসে পৌঁছবে।
তাই আমি বিশেষ কোনও খেয়াল করি নি।
হঠাৎ মোড় নিতেই দেখি, হাতে ঝুলানো ট্রাউট মাছ নিয়ে একটা লোক আমার দিকে এগিয়ে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়—এ জায়গা আবদুর রহমানের পঞ্জশীর।
সামনেই বাজার। ঢুকেই বাঁয়ে দজীর দোকান। ডাইনে ফলওলা—তার পর মুদী-সর্বশেষে চায়ের দোকান। নিদেন একশবার দেখেছি। দোকানীর মেহদি-মাখানো দাঁড়ি, কালে-সাদায় ডোরাকাটা পাগড়ি আবদুর রহমানের চোখ দিয়ে আমার বহুকালের চেনা। আরেকটু হলেই তাকে অভিবাদন করে ফেলতুম। তার দৃষ্টিতে অপরিচিতের দিকে তাকানোর অলস কৌতুহলের স্পষ্টভাষ আমাকে ঠেকালে। এই চায়ের দোকানই আবদুর রহমানের ফার্পো, পেলিটি।
আবদুর রহমান নিরক্ষর। ফার্সী সাহিত্যে তার কোনও সঙ্গতি নেই। কিন্তু সম্পূর্ণ অচেনা জিনিস অজানা পরিবেশ যদি সুদ্ধমাত্র কয়েকটি অতি সাধারণ আটপৌরে শব্দের ব্যবহারে চোখের সামনে তুলে ধরাটা আর্টের সর্বপ্রধান আদর্শ হয়-বহু আলঙ্কারিক তাই বলেন-তবে আবদুর রহমান অনায়াসে লোতি দোদে মম্কে দোস্ত বলে ডাকবার হক্ক ধরে। এ বাজারের প্রত্যেকটি দোকান আমার চেনা—আর এখানে দাঁড়ানো নয়, আবদুর রহমান সাবধান করে দিয়েছিল—এই যে কাঁচাপাকা দাঁড়িওলা লোকটা তামাক খাচ্ছে সে বিদেশীকে পেলেই ভ্যাচর ভ্যাচর করে তার প্রাণ অতিষ্ঠ করে তোলে।
চায়ের দোকান পেরোতেই বাঁ দিকে যে রাস্তা তারই শেষ বাড়ি আবদুর রহমানদের। বাড়িতে সে নেই-কান্দাহারে। তার বাপকে আমি চিনি। ধরা পড়ার ভয় আছে।
সামনে খাড়া হিন্দুকুশ। আবদুর রহমানদের মনে মনে সেলাম জানিয়ে একটু পা চালিয়ে তার দিকে এগোলুম।
হিন্দুকুশে এখনও বরফ তার সর্ব দার্ঢ্য নিয়ে বর্তমান। আসলে তার শরীর সাবুদানার চেয়েও সূক্ষ্ম কণা দিয়ে তৈরি আর হিমকণারই মত নরম। কিন্তু বসন্ত-সূর্যও একে গলাতে পারে নি। শক্তকে ভাঙ্গা যায়, নরমকে ভাঙ্গা শক্ত।
ঝড়-তুফানে দিশেহারা হয়ে আন্ন মৃত্যু সম্মুখে দেখেছি, তখন জানতুম না যে এখানে পথ মাত্র একটিই, নিরুদ্দেশ হবার উপায় নেই। বামিয়ানেও পৌঁছলুম। বিরাট বুদ্ধমূর্তি চোখের সামনে দাঁড়িয়েছিল বলেই চিনলুম, এ জায়গা বামিয়ান না হলে কোনও জায়গার নাম আমি কাউকে জিজ্ঞেস করি নি। মাঝে মাঝে শুধু জানতে চেয়েছি, কেউ বোরকাপরা একটি মেয়েকে একা একা মজারের পথে যেতে দেখেছে কি না? ‘হ্যাঁ’, ‘না’, কাবুলের দিকে গিয়েছে, না, মজারের দিকে গিয়েছে, কোন্ এক সরাইয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে—সব ধরনের উত্তরই শুনেছি। দরদী জন আমাকে কাবুলে ফিরে যেতে বলেছে।
দেখি নি, দেখি নি, কিছুই দেখি নি। কয়েদীকে যখন পাঁচশ মাইল হাঁটিয়ে নিয়ে যাও হয় তখন কি সে কিছু দেখে? সাইবেরিয়া নির্বাসনে গিয়েছেন সেরা সেরা সাহিত্যিক-তাঁরা তো কিছুই দেখেন নি। না হলে শোনাতেন না?
হায় রে হিউয়েন সাঙ! স্মৃতির কপালে শুধু করাঘাত।
হিউয়েন সাঙ এ পথে যেতে ঝড়ঝঞ্জার মৃত্যুযন্ত্রণায় একাধিকবার তাঁর জীবন কাতর রোদনে তথাগতের চরণে নিবেদন করেছিলেন। আমি করি নি। তার কারণ এ নয় যে আমি ভিক্ষুশ্রেষ্ঠর চেয়েও অধিক বীতরাগ-দুঃখে অনুদ্বিগমন, সুখে বিগতস্পৃহ-হয়ে গিয়েছিলুম। আমি হয়ে গিয়েছিলুম জড়, অবশ। ক্লোরোফর্মে বিগতচেৎন রুগীর যখন কাটা যায় সে যে তখন চিৎকার করে না তার কারণ এ নয় যে, সে তখন কায়াক্লেশমুক্ত স্থিতধী মুনিপ্রবর। চিন্তামণির অন্বেষণে বিল্বমঙ্গল যা সব করেছিল সে সজ্ঞানে নয় সম্পূর্ণ মোহাচ্ছন্ন অবস্থায়। কী সুন্দর নাম চিস্তামণি! এ নাম বাঙালী মেয়ে অবহেলা করে কেন? অহল্যার মত ‘অসতী’ ছিল বলে? হায়! আজ যদি ওঁর শুদ্ধজ্ঞানের এক কণা আমি পেয়ে যেতুম!
ক্রমে আমার সময়ের জ্ঞান লোপ পেল। কবে বেরিয়েছি, কবে মজার পৌঁছব কোন বোধই আর রইল না।
সরাইয়ের এক কোণে ঠেসান দিয়ে বসে আছি। যে কাফেলার সঙ্গে আজ ভোরে যোগ দিয়েছিলুম তারা কুঠরির মাঝখানে কুণ্ডলি পাকিয়ে মৃদুস্বরে কথা বলছে। এদের বেশ ভাগই আমুদরিয়া পারের উজবেগ। বাঙলা-ভাষায় এদের বলে উজবুক। এরা যে কি সরল বিশ্বাসে ট্যারা চোখ মেলে তাকাতে জানে সে না দেখলে না শুনে বোঝা যায় না। এদের ভাষা আমার জানা। কিন্তু এরা আমাকে ভালবেসেছে। আজ সকালে একরকম জোর করেই আমাকে একটা খচ্চরের উপর বসিয়ে দিয়েছিল।