সেবারে প্রার্থনান্তে যেন তারই কোলে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম, স্বপ্নে প্রত্যাদেশও পেয়েছিলুম, কান্দাহার যেয়ো না—আমার তখন সেটা মনঃপূত হয় নি।
তাই কি করীম করুণাময় আমাকে শিক্ষা দিতে চাইলেন তাঁর ক্কাহির-রুদ্ররূপে?
সমস্ত রাত চোখে এক ফোটা নিদ্রা এল না।
সমস্ত দিন কাটল ওই ভাবে। মাঝে মাঝে তন্দ্রা আসে। ঘুমে প্রত্যাদেশ পাব আশ করে যেই শুতে যাই, সঙ্গে সঙ্গে সর্ব নিদ্রার অন্তর্ধান। তিন দিন পর যখন নির্জীব, ক্লান্ত দেহে প্রত্যাদেশের শেষ আশা ছেড়ে দিলুম সেদিন সুনিদ্রা হল। আশা ছাড়লে দেখি ভগবানও সমঝে চলেন।
শব্নম যে রকম পূর্ব বাংলার স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসত-যখন-তখন পেশাওয়ার গিয়ে দিল্লী কলকাতা হয়ে পূর্ববাংলায় পৌঁছত, আমিও সেরকম মাজার-ই-শরীফের স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতুম। প্রথম দিন সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তুমি কি সত্যই জান না, হজরৎ আলী (করমল্লাহু ওয়াজহাহু-আল্লা তাঁর বদন জ্যোর্তিময় করুন) মারা যান আরবভূমিতে এবং তার গোর সেখানেই। অশিক্ষিত অজ্ঞ লোকের মত বিশ্বাস কর তার কবর উত্তর আফগানিস্থানে!’
আমি বললুম, যেখানে এত লোক শ্রদ্ধা জানায়, সেখানে না হয় আমি সেই শ্রদ্ধাটিকেই শ্রদ্ধা জানালুম।
অবজ্ঞার সঙ্গে বললে, তা হলে কাবুলী মুটেমজুর যখন নূতন কোনও সোনা বানানেওয়ালা গুরুঠাকুর মুর্শীদাবাবাজীর সন্ধান পেয়ে তার পায়ের উপর গিয়ে আছার খায় তখন তুমিও সে দিকে ছুট লাগাও না কেন? যত সব!
আমি বললুম, ‘মজাই-ই-শরীফে কিন্তু ইরান-তুরান-হিন্দুস্থান আফগানিস্থানের বিস্তর কবি জমায়েৎ হয়ে কবর-চত্বরে সুন্দর সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করেন-মুশাইরা সেখানে সুবো-শাম্।’
সঙ্গে সঙ্গে শব্নমের মুখ খুশীতে ভরে উঠল; তাই নাকি? এতক্ষণ বল নি কেন? চল।
উঠে দাঁড়িয়েছিল। যেন তদ্দশ্যেই আমাদের যাত্রারম্ভ!
শব্নমের কাছে কল্পনা বাস্তবে কোন তফাত ছিল না। না হলে সে আমাকে ভালোবাসল কি করে?
আসলে আমার লোভ হত, হিউয়েন সাঙ তথাগতের দেশ ভারতবর্ষে যাবার সময় যে পথ বেয়ে মজার-ই-শরীফের কাছের বাহুলিক নগরী—আজকের দিনের বল্খ-থেকে বামিয়ানের কাছে হিন্দুকুশ পেরিয়ে কপিশ—আজকের দিনে কাবুল শহর এসে পৌঁছেছিলেন সেই পথটি দেখার। তখনকার দিনে তুষার ভূমি (আজকের তুখার-স্থান) পেরিয়ে যখন বৌদ্ধ শ্রমণ বাহলীকে পৌঁছলেন তখনই তাঁর চোখ জুড়িয়ে গিয়েছিল, তিনি তার অসহ পথশ্রম সার্থক মেনে নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখেছিলেন একশত সঙ্খারাম, তিন শত স্থবির আর কত হজার শ্রমণ-ভিক্ষু কে জানে? এরই কাছে কোথায় যেন ভারতীয় মহাস্থবির প্রজ্ঞাকরের কাছে তিনি অধ্যয়ন করেছিলেন অভিধর্ম। আর বামিয়ানে পৌঁছে দেখেছিলেন, তারও বাড়া—হাজার হাজার সাঙ্ঘারাম-পর্বতগুহায়, সমতল ভূমিতে, উপত্যকায়। আর দেখেছিলেন পাহাড়ের গায়ে দণ্ডায়মান, অসীন, শায়িত শত শত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বুদ্ধমূর্তি। শ’ দুশ ফিউ উঁচু!
তার পর তিনি পঞ্জশীর হয়ে পৌঁছেছিলেন কাবুল উপত্যকায়।
যবে থেকে এখানে এসেছি সেগুলোর সন্ধান করেছি এখানে। এখানে কীর্তিনাশা পদ্মা নদী নেই, এখানে কোনও কিছুই সম্পূর্ণ লোপ পায় না। নবীন যুগের অবহেলা পেলে এখানে প্রাচীন যুগ মাটির তলায় আশ্রয় নিয়ে প্রতীক্ষা করে, কবে নবীনতর যুগের লোক শাবল কোদাল নিয়ে তাদের সন্ধানে বেরবে।
তারও আগের কথা। আমি বাংলাদেশের লোক। হিউয়েন সাঙের ভারততীর্থ পরিক্রমার শেষ প্রাচ্য-প্রান্ত ছিল বাংলা। বগুড়ার কাছে মহাস্থানগড় প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধনে এসেছিলেন বল্খ থেকে হিউয়েন সাঙ আর কয়েক শতাব্দী পরে সেখানেই আসেন ওই বল্খ থেকে দরবেশ শাহ সুলতান বলখী-কত কাছাকাছি ছিল সেদিনের বল্খ আর বগুড়া।
সেই খেই ধরে ধরে দেখেছি, বিক্রমশিলা, নালন্দা? কাবুলে আসার পথে ট্রেন থেমেছিল এক মিনিটের তরে তক্ষশিলায়। সেখানে নামবার লোভ হয় নি একথা বলব না। তারপর পেশাওয়ার-কণিষ্কের রাজধানী। সেখানেও সময় পাই নি। গান্ধারভূমি জালালাবাদে শুধু আখ খেয়েই চিত্তকে সান্ত্বনা দিয়েছি যে, এই আখ খেয়েই হিউয়েন সাঙ শতমুখে প্রশংসা করেছিলেন। ভেবেছিলুম পরবর্তী যুগে এই যে আখের গুড় চীনদেশে গিয়ে রিফাইন্ড হয়ে শ্বেতবর্ণ ধরে যখন ফিরে এল, তখন চীনের স্মরণে এর নাম হল চিনি—তার পিছনে কি হিউয়েন সাঙ ছিলেন? একে উপহাস করেই কি আমাদের দেশে চীনের রাজার আম খাওয়ার গল্প হল?
আজ আবার এই কথা মনে পড়েছে। শব্নম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করত–পূর্ব বাঙলায় তার শ্বশুরের ভিটেয় পৌঁছবার পথে এগুলো পড়ে বলে।
কিন্তু যখন কাবুল ছেড়ে আচ্ছনের মত বেরলুম মজার-ই-শরীফের সন্ধানে তখন এসব কিছুই মনে পড়ে নি। কী কাজে লাগবে আমার এই ‘পাণ্ডিত্যে’র মধুভাণ্ড! জরা-জীর্ণ অর্ধলুপ্ত বাড়ির নিচে লুকনো যে সোনার তাল আছে সেটা কি তার সামান্যতম উপকারে আসে? ওর শতাংশ ব্যয় করে বাড়িটা মেরামত হয়, কলি ফেরানো যায়, সে তার সুপ্ত যৌবন ফিরে পায়। শব্নমই বলেছিল,
‘এত গুণ ধরি কী হইবে বল দুরবস্থার মাঝে,
পোড়ো বাড়িটাতে লুকনো যে ধন লাগে তার কোনো কাজে?’
কবিতা আমার মুখস্থ থাকে না। শুধু শব্নমের উৎসাহের আতিশয্যে আমার নিষ্কর্মা স্মৃতিশক্তিও যেন ক্ষণেকের তরে জেগে উঠত। উর্দুতে বলেছিলুম,
দুর্দিনে, বল, কোথা সে সুজন হেথা তব সাধী হয়,
আঁধার ঘনালে আপন ছায়াটি সেও, হেরো, হয় লয়!