কিন্তু এ সবেতে আমার কী?
আমার স্বার্থ মাত্র এইটুকুই-কাবুল উপত্যকা তো তন্ন তন্ন করে দেখা হয়ে গিয়েছে। এবার যদি বাইরের থেকে কোনও খবর আসে।
আবদুর রহমান এখনও কান্দাহার থেকে ফেরে নি। তার থেকেই আমার বোঝা উচিত এখনও গমনাগমন অসম্ভব।
জানেনের সেবা করতে গিয়ে বার বার হার মানি।
তিনি ডান হাত বাড়িয়ে বাঁ দিকে কি যেন খুঁজলেন। আমি শুধালুম, জানেমা (আমাদের জান্), কী চাই?
‘না বাচ্চা, কিছু না।’
পীড়াপীড়ি করি। নিমকদান-লবণের পাত্র।
শব্নম জানত।
তিনি কবিতা আবৃত্তি করেন; আমি প্রত্যুত্তর দিতে পারি নে।
প্রতি পদে ধরা পড়ে বোর কাজে আমার অনভ্যাস, অপটুত্ব। অথচ ঠিক সেই কারণেই আমি তাঁর কাছে পেলুম আরও বেশী আদর-সোহাগ। শিশুর আধো-আধো কথা শুনে পিতামাতা যে রকম গদগদ হয়, আমার আধো-আধো সেবা তেমনি তাঁর হৃদয়ের দাক্ষিণ্যে যেন বান ডাকালে।
এক রকম লোক আছে যারা সর্বক্ষণ কথা বলে যাওয়ার পর দেখা যায়, তারা কিছুই বলে নি। অন্য দল সংখ্যায় কম। এদের নীরবতা যেন বাঙময়। এঁরা সেই নীরবতা দিয়ে এমন একটি বাতাবরণ সৃষ্টি করেন যে, শুভ মুহূর্তে সেই ঘন বাষ্পে তাঁরা একটি ফোঁটা বাক্-বারির ছোঁয়াচ দেওয়া মাত্রই আকাশ-বাতাস মুখর করে ঝরঝর ধারে বারিধারা নেমে আসে।
এই রকম একটা সুযোগ পেয়ে আমি তাঁকে শুধালুম, আপনি আমার শ্বশুরমশাইকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন। আমাকে বলুন তো, তিনি কান্দাহার যাওয়ার সময় বাড়িতে কেন হুকুম রেখে গেলেন, ডাকাতদের যেন কোনও বাধা না দেওয়া হয়?
জানেম বললেন, আওরঙ্গজেব সাধারণ সেনাপতি নয়। প্রকৃত সেনাপতি যে রকম যুদ্ধ জয় করতে জানে, ঠিক সেই জানে কখন আর জয়াশা করতে নেই। সে সময় সে যতদূর সম্ভব স্বল্প ক্ষয়ক্ষতি হতে দিয়ে সৈন্যবাহিনী রণাঙ্গন থেকে হটিয়ে আনে।
‘আওরঙ্গজেব জানত, বাধা দিলে এ বাড়ির কেউই প্রাণে বাঁচবে না। ওদিকে শব্নমের উপর ছিল তার অগাধ বিশ্বাস। এসব ব্যাপারে সে যেকোনও পুরুষকে ছাড়িয়ে যায়।
একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবে, শব্নম যদি অল্প কিছুক্ষণ জাফর খানকে আটকে রাখতে পারত তা হলেই তো ততক্ষণে বাচ্চার হুকুম পৌঁছে যেত যে তাকে যেন নিরাপদে আপন বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়।’
‘সূফীদের অনেকেই তাই পরিপূর্ণ নিষ্ক্রিয়তায় বিশ্বাস করেন। সৎকর্ম, অসৎকর্ম, প্রয়োজনীয় কর্ম, অপ্রয়োজনীয় কর্ম, যাই কর না কেন, তার ফলশ্বরূপ উৎপাদিত হবে নূতন কর্ম এবং ক্রমাগত বাড়তে থাকে সেই কর্ম-জিঞ্জির-চেন্-অ্যাকশন। এই কিস্মতের অক্ষমালার কোনও জায়গার তো গিট খুলতে হবে। না হলে এই অন্তহীন জপ-মালা তো ঘুরেই যাবে, ঘুরেই যাবে; এর তো শেষ নেই।’
‘অথচ এ কথা আমি স্থির-নিশ্চয় জানি, শব্নম ঠাণ্ডা-মাথা মেয়ে। ক্ষণিক উত্তেজনায় সম্বিৎ হারিয়ে উন্মাদ আচরণ সে করে না। নিশ্চয়ই কোন কিছু একটা চরমে পৌঁছেছিল।’
আমি চিন্তা করে প্রত্যেকটি বাক্য হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করছি এমন সময় দাসীরা কলবর করে ঘরে ঢুকে বললে, ‘একজন বোরকা পরিহিতা রমণীকে হিন্দুকুশের গিরি উপত্যকায় দেখা গিয়েছে মজার-ই-শরীফের পথে যেতে।’
চিৎকার চেচামেচির মাঝখানে এইটুকু বুঝতে আমাদের অনেকক্ষণ সময় লেগেছিল।
জানেমন্ নীরব।
আমি তাড়াতাড়ি মনসূরকে চিঠি লিখলুম সে যেন পত্রপাঠ ইউসূফকে সঙ্গে নিয়ে আসে। অন্য লোক পাঠালুম সরাইখানাতে।
কিন্তু শব্নম আফগানিস্থানের উত্তরতম প্রদেশ সুদূরতম তীর্থ মজার-ই-শরীফের দিকে যাচ্ছে কেন? প্রাণ রক্ষার্থে? সে কি জানে না জাফর খানের খুনের জন্য বাচ্চা তার খুন চয় না?
ঘণ্টা দুয়েকের ভিতর মনসূর এল। সহৃদয় সরাইওয়ালাও স্বয়ং এসে উপস্থিত। ইউসুফ আসে নি। খবর পাঠিয়েছে, বহু বোরকাপরা রমণী বহু তীর্থে একা একা যায়। এ রমণী কিছুতেই শব্নম বানু হতে পারেন না। আরও বলেছে, এ রকম গুজব এখন ঘড়ি ঘড়ি বাজারে রটবে—আমি যেন ওসবেতে কান দিই।
মনসূর বললে, ইউসূফ তো আসবে না, পকা খবর না নিয়ে। আমি এই গুজবটা শুনতে পাই কাল। সঙ্গে সঙ্গে গেলুম সরাইয়ে। তারা খবর পেয়েছে তার আগের দিন। তার পর গেলুম ইউসুফের কাছে। সে বললে, এসব পুরনো খবর। মিথ্যে—সে যাচাই করে দেখেছে। তার পর, হুজুর, আমাকে হিসেব করে দেখালে, কাবুল গিরিপথের বরফ গলতে যে সময় লাগে তার আগে সেটা ছড়িয়ে কেউ হিন্দুকুশ পৌঁছতে পারে না। ও মেয়ে হিন্দুকুশ অঞ্চল থেকেই বেরিয়েছে। আরও অনেক কি সব প্রমাণ দিলে যেগুলো আমি বুঝতেই পারলুম না।
সকলেরই এক মত। ও মেয়ে কিছুতেই কাবুল থেকে বেরোয় নি। ওর সন্ধান করতে যাওয়া আর চাঁদের আলোতে কাপড় শুকোতে দেওয়া একই কথা।
আমি সম্ভব অসম্ভব নানা প্রকারের যুক্তিহীন তর্ক, এবং তকহীন নীরবতা দিয়ে আপাতদৃষ্টিতে যা অসম্ভব তা সম্ভব হতে পারে বোঝাবার চেষ্টা করলে সবাই এমন সব অভিজ্ঞতা প্রসূত যুক্তি এবং প্রত্যক্ষদৃষ্ট আপত্তি তুললে যে শেষটায় আমি রেগে উঠলাম। তধন সবাই একে অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে চুপ করে গেল।
আমি আমার আহম্মুকি বুঝতে পারলুম। এদের না চটিয়ে এদের কাছ থেকে আমার জেনে নেওয়া উচিত ছিল, মাজার শরীফ যাবার জন্য আমার কি প্রস্তুতির প্রয়োজন? এখন যখন শুধালুম, সবাই আশকথা পাশকথা বলতে বলতে বাড়ি চলে গেল।
কান্দাহার থেকে শব্নমের কোনও খবর না পেয়ে শেষটায় স্বপ্নে প্রত্যাদেশ ভিক্ষে করেছিলুম, কান্দাহার যাব কি না, আজ রাত্রে ঠিক তেমনি সমস্ত হৃদয় মন ঢেলে দিয়ে নামাজ পড়লুম মাঝ রাত অবধি। বার বার কাতর রোদনে প্রভুকে বললুম, হে করুণাময়, আমাকে দয়া কর, আমাকে দয়া কর।