বেদনা আমার জিহ্বার জড়তা কেটে ফেলেছে। বললুম, একাত্ম দেহ হতে পারলে তার বিরহে বেদনা পেতুম না, আর চিন্তা অসহ্য হত না।
গভীর সস্মেহ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ভয় নেই। ঠিক পথে চলেছ। একাধিক সূফী বলেছেন, আল্লার দিকে মন যাচ্ছে না আত্মার দিকে মন যাচ্ছে না-? না-ই বা গেল। তোমার কাছে সব চেয়ে যা প্রিয় তাই নিয়ে ধ্যানে বস। সে যদি সত্যই প্রিয় হয় তবে মন সেটা থেকে সরবে কেন?—আর মূল কথা তো মনকে একত্র করা, অর্থাৎ মনকে শান্ত করা।’
‘আসলে কী জান, মন গঙ্গাফড়িঙের মত। খনে সে এদিকে লাফ দেয়, খনে ওদিকে লাফ দেয়। এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকেতে চায় না। কিংবা বলতে পার, কাবুল উপত্যকার চাষার মত ছায়ায় জিরোচ্ছে, কিন্তু কিছুক্ষণ না যেতে-যেতেই রৌদ্রে গিয়ে কাজ করছে, ফের ছায়ায় ফিরে আসছে, ফের রৌদ্র, ফের ছায়া।’
‘তার গায়ে জ্বর-তোমার মত। তাকে এক নাগাড়ে সমস্ত দিনই ছায়ায় শুইয়ে রাখতে হবে। তবে ছাড়বে তার জ্বর।’
তোমার মন হবে শান্ত।
সূফী সাহেব থামলেন। আমি সব কিছু ভুলে গিয়ে শুধালুম, তার পর?
ইচ্ছে করে অবাক হওয়ার ভান করে বললেন, তার পর আর কি বাকী রইল? তখন মালিক যা করার করবেন। তুমি তখন শান্ত হ্রদ-মালিক তাঁর ছায়া ফেলবেন। তোমার অজ্ঞেয় অগম্য কিছুই থাকবে না।
হেসে বললেন, তাঁকে তো কিছু একটা কর দিতে হয়। সব দুর্ভাবনা কি তোমার?
আমি সেই পুরাতন প্রশ্ন শুধালুম, যে প্রশ্ন আজ নয়, বহুকাল ধরে মনে জেগে আছে-‘বিরাট বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কথা যখন চিন্তা করি, কল্পনাতীত অন্তহীন দূরত্বের পিছনে বিরাটতর অসংখ্য ব্রহ্মাণ্ডের সংবাদ যখন বৈজ্ঞানিকেরা দেয় তখন ভাবি, আমি এই কীটের কীট, আমার জন্য আর কে কতখানি ভাবতে যাবে?’
সূফী সাহেব বললেন, ‘সেটা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে তোমার উপর।’
‘এই যে কোটি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কথা বললে তুমি কল্পনা কর না কেন, তিনি আরও কোটি কোটি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মালিক। তা হলেই তো তিনি সম্পূর্ণ একটা ব্রহ্মাণ্ড তোমার-একমাত্র তোমারই দেখাশোনার জন্য মোতায়েন করতে পারেন। তা হলেই দেখতে পাবে, লক্ষ লক্ষ ফিরিশতা-দেবদূত তোমার দিকে অপল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন, তোমার প্রতিটি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের হিসাব রাখছেন হাজার হাজার দেবদূত, তোমার প্রতিটি হৃদস্পন্দনের খবর লিখে রাখছেন লক্ষ লক্ষ ফিরিশতা। আর তুমি যদি কল্পনা কর তোমার খুদা মাত্র দশটা ব্রহ্মাণ্ডের মালিক তা হলে অবশ্য তুমি অসহায়।
‘কিন্তু তিনি তো অনন্ত রাজ। তিনি সংখ্যাতীতের মালিক।’
‘কত সহস্ৰ ব্ৰহ্মাণ্ড চাও, একমাত্র তোমারই তদারকি করার জন্য?’
আমি অভিভূত হয়ে তাঁর কথা শুনে যাচ্ছি এমন সময় তিনি আমাকে যেন সর্বাঙ্গ ধরে দিলেন এক ভীষণ নাড়া। বললেন, কিন্তু এ সব কথা বৃথা, এর কোনও মূল্যই নেই। কারণ গোড়াতেই বলেছি, আপন মনকে না চিনে সেই মন দিয়ে কোনও কিছু বোঝার চেষ্টা করা বৃথা। তার প্রমাণস্বরূপ দেখতে পাবে, বাড়ি পৌঁছতে না পৌঁছতেই তোমার গাছতলার ছায়ার চাষা আবার রৌদ্রে ঘোরাঘুরি করছে তোমার মন আমার কথাগুলোর দিকে আর কান দিচ্ছে না। এবং এগুলো আমার কথা নয় বড় বড় সূফীরা যা বলেছেন তারই পুনরাবৃত্তি করেছি মাত্র।
আমি নিরাশ হয়ে বললুম, তা হলে উপায়?
বেশ দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, ‘মনকে শান্ত করা। আর ভুলে যেয়ো না, সাধনা না করে কোন কিছু হয় না। পায়লোয়ানের উপদেশ পড়ে মাংসপেশী সবল হয় না, হেকিমীর কেতাব পড়ে পেটের অসুখ সারে না। মনকে শান্ত করতে হয় মনের ব্যায়াম করে।
‘আর ঠিক পথে চলেছে কি না তার পরখ-প্রতিবার সাধনা করার পর মনটা যেন প্রফুল্লতর বলে মনে হয়। ক্লান্তি বোধ যেন না হয়। পায়লোয়ানরাও বলেছেন, প্রতিবার ব্যায়াম করার পর শরীরটা যেন হালকা, ঝরঝরে বলে মনে হয়।’
না হলে বুঝতে হবে, ব্যায়ামে গলদ আছে।
আমাদের সামনে হালুয়া ধরে বিদায় দিলেন।
আমরা আসন ছেড়ে উঠেছি এমন সময় তিনি হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বাচ্চা, তোমার একটি আচরণে আমি খুশী হয়েছি। গ্রামের চাষা তিন মাস রোগে ভুগে শহরে এসে হেকিমের কাছ থেকে দাওয়াই নিয়েই শুধায়, “কাল সেরে যাবে তো?” -তুমি যে সেরকম শুধাও নি, ফল পাবে কবে?
‘ফল নির্ভর করে তোমার কামনার দৃঢ়তার উপর। দিল্কে একরুজু করে যদি প্রাণপণ চাও, তবে দেখবে নতীজা নজ্দিক—ফল সামনে।’
ধর্মে ধর্মে তুলনা করার মত মনের অবস্থা আমার তখন নয়। তবু মনে পড়ে গেল, সংস্কৃত ব্যাকরণের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে গুরুকে শুধিয়েছিলুম, ‘অনায়াসে সংস্কৃত কাব্য পড়তে পারব কবে?’ তিনি বলেছিলেন, “তীব্র সংবেগানাম্ আসন্ন?” অর্থাৎ আবেগ তীব্র থাকলে ফল আসন্ন।
তার পর বলেছিলেন, শুধু, ভাষার ক্ষেত্রে নয়, সর্বত্রই এটা প্রযোজ্য—পতঞ্জলি বলেছেন ‘যোগসূত্রে’ সাধনার ক্ষেত্রে।
৩.৪ আমার মন শান্ত হয় নি
আমার মন শান্ত হয় নি, অশান্তও থাকে নি। আমার মানস সরোবরের জল জমে বরফ হয়ে গিয়েছে।
ওদিকে কাবুলের বরফ গলতে আরম্ভ করেছে। কবুল উপত্যকার উত্তর-পূর্ব-পশ্চিম গিরিপথে সঞ্চিত পর্বত প্রমাণ তুষার-স্তূপও গলতে আরম্ভ করেছে। এবার জনগণের গমনাগমন আরম্ভ হবে। যে পণ্যবাহিনী এখানে আটকা পড়েছিল তারা হন্যে হয়ে উঠেছে গন্তব্যস্থলে পৌঁছবে বলে। কাবুল উপত্যকার বাইরে যারা আটকা পড়েছিল তারও যে করেই হোক শহরে ঢোকবার চেষ্টা করবে। সঙ্গে সঙ্গে ডাকাতিরও মরশুম গরম হয়ে উঠবে। বাচ্চার বাহুবল উপত্যকার বাইরে সম্প্রসারিত নয়। কাজেই দুদলে লড়াই লাগবে মোক্ষম। তার কারণ এ দেশের ডাকাত আর বণিকে তফাত কম। যে দু’দিন পূর্বে বণিক ছিল সে কিছুটা পয়সা জমিয়ে ডাকাতের দল গড়েছে। আবার যে দুদিন পূর্বে ডাকাত ছিল সে কিছুটা পয়সা করে আজ পণ্যবাহিনী তৈরি করেছে এবং এর পরও অন্য এক শ্রেণীও আছে। এরা দুটো একসঙ্গে চালায়। পণ্যবাহিনী নিয়ে যেতে যেতে সুযোগ পেলে ডাকাতিও করে।