আমি কি বলব, কি ভাবব। মনসূরের দার্শনিক কাব্যাবৃত্তি আমার ভালোও লাগে নি মন্দও লাগে নি।
মনসূর শেষ কথা বললে, কিন্তু দেখুন হুজুর কর্নেলের স্ত্রী ভেঙে পড়েন নি।
আমি গুরু, সে শিষ্য।
মনে নেই, হয়তো কোনও দিন ক্লাসে চরিত্রবল সম্বন্ধে বক্তৃতা দিয়েছিলুম।
আবদুর রহমান বাড়ি ফেরে নি।
কাবুল নদীর পোলের উপর তার সঙ্গে দেখা। গায়ে ওভার কোট নেই। বাকী জামকাপড় টুকরো টুকরো। মনসূর তার সঙ্গে কথা বললে। বলার শোনার কিছু নেই। আবদুর রহমান ঘণ্টা তিনেক ওই জনসমুদ্র মন্থন করেছে। গালে, বাহুতে, হাতের কাছে জখমও তার দেখতে পেলুম। কোনও গতিকে পা টেনে টেনে চলে আসছিল। কিছুতেই বাড়ি যেতে রাজী হল না।
আর্কের সামনে দুটি একটি লোক। সেখানে মার্শল ল। পাঁচজনের বেশী একত্র দেখলে শাস্ত্রীদের গুলি চালানোর হুকুম। জায়গাটা এখন প্রায় ফাঁকা।
আবদুর রহমান মনসূরকে বলে, হুজুরকে বলুন, এ জায়গায় সব তন্ন তন্ন করে দেখেছি। এই পেয়েছি।
তাকিয়ে দেখি আমার পাঞ্জাবির—আমারই হবে এক পাশের ছেড়া কাপড়ের সঙ্গে একটি পকেট। এদেশে এরকম সাইড পকেটওয়ালা পাঞ্জাবি হয় না। এটা শব্নম আমার কাছ থেকে নমুনা হিসেবে নিয়ে গিয়েছিল, একদিন ওইটে আমার ঘরে পরেছিল।
এইটে পরেই কি সে আর্কে এসেছিল?
দয়াময়, দয়া কর।
অনেকক্ষণ পর মনসূর মৃদুস্বরে ফের শুধালে, কোথায় যাবেন, হুজুর?
‘তোমার বাড়ি।’
ভারী খুশী হয়ে বললে, তাই চুলন হুজুর। আমি তাকে খুশী করার জন্য প্রস্তাবটি করি নি। তার কাছ থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য। নেমক-হারামী? হ্যাঁ। কিন্তু আমি একা, একবার নিজের সঙ্গে একা হতে চাই।
আবদুর রহমানকে নিয়েও বিপদ। শেষটায় যখন বললুম, কর্নেলের ছেলেকে বসিয়ে রাখার হক্ক আমাদের নেই—তার মা ওদিকে হয়তো ব্যাকুল হচ্ছেন তখন সে রাজী হল। বাড়িতে ঢোকার সময় হঠাৎ তার মুখে হাসি ফুটল। কেন? হায় রে! যদি বীবী সাহেবা ওই বাড়িতে ওঠেন!
মনসূর আমাকে খাওয়াবার চেষ্টা করেছিল। বলেছিল সে জানে, আমি সমস্ত দিন কিছু খাই নি। আগের রাত্রে কতখানি খেয়েছিলুম, সে পাশে বসে দেখেছে—সে তো বরের খাওয়া!
তার প্রত্যেকটি কথা আমার বুকে বিঁধছিল। কেন সে কাল রাত্রের কথা আমাকে স্মরণ করায়? আমি বললুম, ‘বাবা, আমি এখন কিছু খেতে গেলে বমি হবে।’
কোথায় যাই? কোথায় সন্ধান করি? কোথায় গেল সে? একটা মানুষ কি করে হঠাৎ অদৃশ্য হতে পারে? কেন দেখা দিচ্ছে না? জাফরকে খুন করল কাদের ভয়ে? খবর পাঠাচ্ছে না কেন? আমাকে জড়াতে চায় না বলে। কিংবা–কিংবা না, না, আমি অমঙ্গল চিন্তা করব না।
এই দুপুর রাত্রে কার কাছে গিয়ে আমি সন্ধান নিই? কড়া নাড়লে তো কেউ দরজা খুলবে না। নিশ্চয়ই ডাকাত-বাচ্চার ডাকাত। গৃহস্থ গুলি ছুড়তে পারে। তা ছুড়ুক।
মাত্র একটি প্রাণীর কথা মনে পড়ল। শব্নম বিয়ের রাতে বলেছিল না পরে? আমার যে সব গুলিয়ে যাচ্ছে-যে তার সখীদের সে ভুলে গিয়েছে। তখন একজনের নাম ও করেছিল। সে-ই তা হলে সব চেয়ে তার প্রিয় সখী। বাড়িটা আবছা আবছা চিনি-স্বামীর নাম থেকে। তখন শুনেছিলুম কান না দিয়ে। সেখানেই যাই। আর্কের অতি কাছে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আশ্রয় নিতে হলে সেই তো সবচেয়ে কাছে।
আর্কের কাছে এসেছি। ক্লান্তিতে পা দু’খানা অবশ হয়ে এসেছে-না শীতে। হঠাৎ মনে হল, শব্নম যদি ইতিমধ্যে বাড়ি ফিরে থাকে? হে খুদা! পাগলের মত ছুটলুম বাড়ির দিকে।
বাড়ি থেকে আবার বেরিয়েছি। কেউ ছাড়তে চায় নি। জানেমন্ শুধু বলেছিলেন, ‘বে-ফায়দা, বে-ফায়দা কিন্তু ঠেকাবার চেষ্টা করে নি।’
বাঁচালে। চাঁদ মেঘে ঢাকা পড়েছে। রাত কটা হল? ঘড়িতে দম দেওয়া হয় নি। চাঁদটা কাল রাতের কথা বড্ড বেশী স্বরণ করিয়ে দেয়। যেন আমার আপন মন নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিতে কিছু কসুর করছে!
কাবুলে দিনদুপুরেও অপরিচিতজনকে কেউ কোনও বাড়ি বাতলে দেয় না। কে জানে তুমি কে? হয়তো রাজার গুপ্তচর। তার বিপদ ঘটাতে এসেছ। বন্ধুজন যদি হবে তবে তো বাড়ি তোমার চেনা থাকার কথা।
এ-রাজা আবার ডাকু। বেধড়ক লুটপাট হচ্ছে। তার উপর রাত দুপুর। তিনটেও হতে পারে।
তবু বাড়ি খুঁজে পেয়েছিলুম। দরজাও খুলেছিল।
শব্নমের নববর গভীর রাতে নিজের থেকে এসেছে—যার সঙ্গে কোনও চেনা-শোনা নেই। আনন্দোল্লাস হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু এরা আর সব খবর ইতিমধ্যেই পেয়ে গিয়েছে। শোকে আনন্দে মিশিয়ে তারা আমাকে যা অভ্যর্থনা জানিয়েছিল সে রকমধারা অপরিচিতের বাড়িতে কেউ কখনও পায় আমি কল্পনাই করতে পারি নি। মুরুব্বীরা কেমন যেন অপরাধীর মত ম্লান হসি হেসে আমাদের একা রেখে চলে গেলেন। সখীর স্বামী বয়সে কম হলেও বিচক্ষণ লোক। আমাকে সখী-গুল্-বদন বানুর কাছে বসিয়ে কি একটা অছিলা করে উঠে গেলেন।
সম্পূর্ণ অপরিচিত আমি—শাস্ত্রে নিশ্চয়ই বারণ—তবু সে আমাকে একা পাওয়া মাত্রই আমার হাত দুখানা নিজের হাতে তুলে চোখে ঠেকিয়ে ভেজিয়ে দিয়েছিল। আমাদের নিয়ে সে কত সুখস্বপ্ন দেখেছিল সে কথা বলতে বলতে বার বার তার গলা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল আর কখনও বা হাউহাউ করে কেঁদে উঠেছিল।
‘কোথায় যতে পারে? তাকে কে না স্থান দেবে? কিন্তু আমার বাড়িতে না এসে অন্য কার বাড়িতে যাবে? আমার শ্বশুর তার জ্যেঠার বিশেষ বন্ধু।’
হঠাৎ তার কি খেয়াল গেল জানি নে। বলে উঠল, ‘তাই হয় তো হবে, হ্যাঁ, তাই!’ যেন আপন মনে চিন্তা করছে। আমি কোনও কথায় বাধা দিই নি। পাছে সামান্যতম কোনও দিকনির্দেশ তারই ফলে কাটা পড়ে যায়, এবং পরে সেটা তার স্মরণে না আসে।