‘বড় সাহেব বাচ্চার খাসকামরার শব্দ শুনে বুঝলেন, মোল্লারা সেখানে জমায়েৎ। এরা কাবুল শহরের সব চেয়ে অপদার্থ। আমানুল্লার আমলে এরা প্রায় ভিক্ষা করে জিন্দেগী চালাচ্ছিল। এদের কোন্ গোঁসাই বড় সাহেবের নুন-নেমক খায় নি—তিনি তো দানের সময় পাত্রপত্র বিচার করেন না।
‘বড় সাহেব সেখানে দাঁড়িয়ে বাচ্চাকে অভিসম্পাত করতে লাগলেন।’
‘সে আমি আপনাকে বলতে পারব না, হুজুর; এতো গাল-গালাজ, চিৎকার চেঁচামেচি নয়। তিনি শান্ত, দৃঢ়, উচ্চকণ্ঠে যেন আল্লার হয়ে পৃথিবীর সর্ব নরাধম পশুকে তাদের জন্য ভবিষ্যদ্বাণী করে যাচ্ছিলেন।
‘হঠাৎ তার বন্ধ চোখ ফেটে রক্ত বেরল। আমার শোনা কথা, যৌবনে চোখের অপারেশন প্রায় শুকিয়ে গিয়ে জ্যোতি ফিরে পাবার মুখে তাঁর গলায় কি আটকে গিয়ে তিনি বিষম খান। তখন ব্যাণ্ডেজের উপর দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে। সেই হয় সর্বনাশ। আজ আমি দেখি, কোনও কিছুনা, হঠাৎ বন্ধ চোখ দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে।
‘পাপ পুণ্যের কি জানি, হুজুর? অপনার কাছেই তো শিখছি। জানি কুমারী, বিধবা, কোনও অবলাকে ধরে নিয়ে যাওয়া পাপ, আর ইনি তো বিবাহিতা, রমণী। মোল্লারা, ওই অপদার্থ মোল্লারা—’
আমি ক্ষীণ কণ্ঠে বললুম, সব মোল্লাই কি—?
বললে, সে আমি জানি নে, হুজুর। আপনিও তো একদিন ক্লাসে নিজেকে মোল্লা বংশের ছেলে বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। আমিও মোল্লা, মোল্লার বেশে ওইখানে গিয়েছিলুম বলে।
‘সেই মোল্লাদের প্রবীণ যিনি, তাঁর আদেশে বড় সাহেবকে একটা কুঠরিতে নিয়ে বন্ধ করে রাখা হল। তাঁকে নিয়ে যাওয়ার পর সে বললে, কি বলতে কি বলে ফেলবেন ইনি। হাজার হোক নূতন বাদশাকে চটিয়ে লাভ কি? হয়তো এরা সত্যই আমাদের সাহায্য করতে চেয়েছিল।
‘ফরসা লোকও ভয় পাংশু হয়-নির্লজ্জও লজ্জা পায়।’
সে সব কথা থাক।
‘সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ খবর এলো—কি করে, কোথা থেকে জানি নে, শব্নম বীবী জাফর খানকে গুলি করে মেরে ফেলেছেন।’
হুজুর, আপনি শক্ত হন।
‘আর জাফরের যে দেহরক্ষী শব্নম বীবীকে বন্দীখানায় নিয়ে যাচ্ছিল সে ও শব্নমবীবী দুজনেই অন্তর্ধান করেছেন।’
আমি বেরবার জন্য তৈরি ছিলুম। বললুম, বৎস, তুমি আমার অনেক উপকার করেছ। এখন তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আমি সন্ধানে বেরই।
সে বললে, আপনি সব কথা শুনে নিন। বড় সাহেব সেই হুকুম করেছেন।
‘যে রক্ষী শব্নম বীবীকে নিয়ে যাচ্ছিল সে এখন বড় সাহেবের পা ধরে কাঁদছে। তাকে ডাকব, না আমি বলব? আদেশ করুন।’
আমি কিছুই হৃদয়ঙ্গম করতে পারছি নে।
বললে, ওর বাপদাদা সাহেবদের নুন খেয়েছে কান্দাহারে। সে ডাকাত হয়ে বাচ্চার দলে ভিড়েছে। সে যা বলেছে তার মূল কথা, শব্নম বীবীকে প্রথমটায় একটা কুঠরিতে বন্ধ করে রাখা হয়। সন্ধ্যার দিকে জাফর তাকে ডেকে পাঠায়। জাফর সে ঘরে একা ছিল। ভিতরে কি হয়েছিল কেউ বলতে পারবে না একমাত্র শব্নম বীবী ছাড়া। হঠাৎ একটি মাত্র গুলি ছোড়ার শব্দ হল। দেহরক্ষীর দল যা দেখবে ভেবেছিল, দেখল তার উল্লোটা। জাফর খান ভয়ে লুটিয়ে আর শব্নম বীবীর হাতে পিস্তল। হাসান আলী—আমাদের এই রক্ষী বললে, সে কিছুই জানত না। আর পাঁচজন রক্ষীর সঙ্গে ছুটে গিয়ে সে এই প্রথম দেখলে তার মনিবদের ঘরের মেয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে।
হাসান আলী ডাকাত—আহাম্মুক নয়। সে তখন নাকি শব্নম বীবীকে বন্দীখানায় নিয়ে যাওয়ার ভান করে আর্কের দেউড়ির দিকে রওয়ানা দেয়।
মনে পড়লো, শান্তির সময়ও জানতুম না, শব্নমকে কোথায় খুঁজতে হবে।
‘ইতিমধ্যে বাচ্চ-ই সকাও আর্কে ফিরেছেন এবং তার কিছুক্ষণ পর হাজার হাজার লোক, এবং শত শত ঘোড়া-গাধা-খচ্চরে চড়ে গাঁয়ের লোক এসেছে, নূতন বাদশাকে অভিনন্দন জানাতে—সোজা ফার্সীতে বলে, ইনাম, বখশিশ, লুটের হিস্যা কুড়োতে। এরা একবার আর্কে ঢুকতে পারলে বেশ কিছুটা খণ্ড-যুদ্ধ লেগে যাওয়া বিচিত্র নয়। জাফর খান তাই আগেই হুকুম দিয়ে রেখেছিল, জনতা দুর্গে ঢোকার চেষ্টা করলে তাদের যেন ঠেকানো হয়। লেগে গেল ধুন্দুমার। আপনি তার শেষটুকু দেখেছেন, হুজুর—বুঝুন তখন কি হয়েছিল।
বাচ্চা ফিরতেই মোল্লারা তাকে সবকিছু বলে শব্নম বীবীকে ছেড়ে দিতে বলে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নাকি খবর আসে জাফর খান খুন হয়েছে। এবং আশ্চর্য, শব্নম বীবীকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাচ্চার হুকুমে সমস্ত আর্ক তন্ন তন্ন করে তালাশ করা হয়েছে।
আমি শুধালুম, হাসান আলী কি বলে!
‘ওই এক কথা—“আমার কোনও দোষ নেই, আমার কোনও কসুব নেই।” ভিড়ের চাপে নাকি একে অন্যের কাছ থেকে ছিটকে পড়ে!’
সে কতক্ষণ হল?
‘ঘন্টা দুই হবে। আপনি তো সে ভিড়ের এক আনা পরিমাণ দেখলেন।’
‘হসান আলীকে ডাক।’
এল। আমার যা জানার চেয়ে প্রয়োজন সে কি আমি প্রশ্নের পর প্রশ্ন শুধিয়ে জিজ্ঞেস করি নি। ওই এক কথা। হাসন আলী হঠাৎ দেখে, শব্নম বানু তার কাছে নেই -ওই এক কথা।
আমি মনসূরকে বললাম, চল।
দেউড়িতে এসে মনসূর শুধালে, কোথায় যাবেন, হুজুর?
তাই তো। কোথায় যাব? ‘চল, আর্কে। না। চল, আবদুর রহমান কোথায় দেখি।’
কর্নেলের বাড়ি পৌঁছতে মনসূর সেখানে খবর নিলে। যখন ফিরলো তখন তার মুখ দেখেই আমি বুঝতে পারলুম, কোনও খবর নেই। মনসূর কিছুক্ষণ পরে বললে, কর্নেলের বীবী আপনাকে বলতে বললেন, শব্নম বীবীকে লুকেবার প্রয়োজন হলে তিনি প্রস্তুত আছেন। তাদের গায়ের বাড়ি সম্পূর্ণ নিরাপদ। তারপর মনসূর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে, কর্নেলের মত সজ্জন লোক মারা গেলেন যুদ্ধে—আর বেঁচে রইল এই ডাকাতরা। তারপর বিড়বিড় করে স্কুলপাঠ্য বই থেকে বিখ্যাত কবিতা আবৃত্তি করলে, “তন্বঙ্গী কুমারী লজ্জা নিবারণের ট্যানা এই বলে বাড়ি থেকে বেরতে পারছে না, আর ওদিকে বড়লোকের কুকুর মখমলের বিছানায় শুয়ে আছে। হে সংসার, আমি তোমার মুখের উপর থুথু ফেলি।”