সে কী ছবি! চতুর্দিকের স্ত্রী ফিরিশতাগণের চোখে পলক পড়ছে না। দিব্যজ্যোতি ধারণ করে লায়লী মজনূঁ বসে আছেন মুখোমুখি হয়ে। ফিরিশত-প্রবীণ জিব্রাইল তাঁদের সম্মুখে ধরেছেন পানপাত্র-আল্লাহতালা কুরান শরীফে যে শরাবুনতহূরা দেবেন বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে আছেন তাই জিব্রাইলের হাত থেকে তুলে নিয়ে লায়লী এগিয়ে ধরেছেন মজনূঁর সামনে। দিব্যজ্যোতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে সে সুধাপাত্র হতে।
চতুর্দিকে মধুর হতে মধুরতর সঙ্গীত :
হে প্রেম, তুমি ধন্য হলে লায়ণী মজনঊঁর বক্ষমাঝে স্থান পেয়ে!
হে প্রেম, তুমি অমরত্ব পেলে লায়লী মজনূঁর মৃত্যুর ভিতর দিয়ে।
খুদাতালার সিংহাসন থেকে ঐশীবাণী উচ্চারিত হল :
হে সুরলোকবাসীগণ! প্রেমের দহন দহন দাহে হয়ে অর্জন করেছ তোমরা সুরলোকের অক্ষয় আসন।
হে মর্ত্যবাসীগণ! সর্বচৈতন্য সর্ব কল্পনার অতীত যে মহান সত্ত্বা তিনি তার বিশ্বরূপ ব্রাহ্মণ্ডস্বরূপের একটি মাত্র রূপ প্রকাশ করেছেন মর্ত্যলোকে-তাঁর প্রেমরূপ।
৩.১ যে মানুষ ছেলে-বয়স থেকে অন্ধের সেবা করেছে
তৃতীয় খণ্ড
যে মানুষ ছেলে-বয়স থেকে অন্ধের সেবা করেছে তার সেবা হয় নিখুঁৎ। এতখানি পাওয়ার পরও যে আমি শব্নমের সেবার দিকে খুঁৎখুঁতে চোখে তাকিয়েছিলুম, একথা বললে নিজের প্রতি অপরাধ করা হয়। আমি দেখেছিলুম, অনুভব করেছিলুম তার সেবা-নৈপূণ্য, আর্টিস্টের মডেল যে রকম ছবিটি যেমন যেমন এগোয় তকে মাঝে মধ্যে সন্তুষ্ট নয়নে দেখে যায়।
ভোরবেলা অনুভব করলুম, চতুর্দিকে লেপ গুঁজে দেওয়ার সময় তার হাতের ভীরুস্পর্শ।
সকালবেলা সামনে যে ভাবে চায়ের সরঞ্জাম সাজালে তার থেকে বুঝলুম, কান্দাহারে যে হাত বুলবুল-গুলের মাঝখানে বিচরণ করেছে সে মাটিতে নামতে ও জানে।
হঠাৎ লক্ষ্য করলুম, শব্নমের চোখ দুটি লাল। আমার হাতের পেয়ালা ঠোঁটে যাবার মাঝপথে থমকে দাঁড়ালো।
শব্নম বুঝেছে। বললে, আজ অতি ভোরে বাবা কান্দাহার চলে গিয়েছেন। তোপল্ খান এসে খবর দিলে, আমানুল্লা তাকে তার শেষ ভরসার মালিকরূপে চিনতে পেরেছেন। বাবা জানেন, আমানুল্লার সর্বআমির-ওমরাহ তাকে বর্জন করেছেন, কুরবানীর ছাগলকেও মানুষ জল দেয়, তারা—থাকগে।
‘যাবার সময় বলে গেছেন, তুমি যেন সকালবেলাই ব্রিটিশ লিগেশনে নিজে গিয়ে আমাদের বিয়ের দলিল জিম্মা করে আসো!’
আর কি বলেছেন?
‘বলেছেন, সুযোগ পেলে তুমি একাই হিন্দুস্থানে চলে যেয়ো।’
তুমি? সেই তো ভালো।
না। তুমি। তার মুখ খুশীতে ভরে গিয়েছে। বললে, জান, আব্বা এখন তোমাকে আমার চেয়েও বেশী ভালবাসেন। বললেন, ‘কেন বেচারীকে আমাদের ঘরোয়া বিপদের ভিতর জড়ালুম।’ এই প্রথম দেখলুম, বাবা কোনও কাজের জন্য অনুশোচনা করলেন। তখন আমি তাকে বললুম-অবশ্য আমি আগেই স্থির করে রেখেছিলুম, এক দিন না এক দিন জানেমন্কে দিয়ে বলাবো—যে তোমাকে আমি আগের থেকেই ভালবাসতুম। আমাদের প্রথম শাদীর কথাটা কিন্তু বলি নি। সেটা বলবো, যেদিন তাঁর কোলে তাঁর প্রথম নাতি দেব। বাবা ভারী খুশী হয়ে নিশ্চিন্ত মনে কান্দাহার গেছেন।
আমি ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করলুম। শেষটায় বললুম, তোপলের সঙ্গে একবার দেখা হল না।
বললে, সে আস্তে আস্তে তোমাকে দেখে গেছে। তুমি তখন ঘুমুচ্ছিলে। আর তোমাকে বলতে বলে গেছে, সব কিছু চুকেবুকে গেলে তার আপন দেশ মজার-ই-শরীফে আমাকে নিয়ে যেতে।
ছোট্ট বাচ্চাকে মা যে রকম জামা কাপড় পরাতে ইচ্ছে করে দেরী করে, প্রতিপদ চড়াবার পর বাচ্চাটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে, শব্নম ঠিক সেই রকম আমাকে জামকাপড় পরালে। যখন আমার জুতোর ফিতে বাধতে গেল মাত্র তখনই বাধা দিয়েছিলুম।
শব্নমের মুখে হাসি কান্না মাখানো। তার পিছনে গাম্ভীর্য। আমি ঠিক বুঝতে পারলুম না।
দেউড়ি পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে বললে, ‘বেশী দেরী করো না।’
তার পর কানে কানে বললে, তুমি আমার মিলনে অভ্যস্ত হয়ে যেয়ো না।
বয়স্করা বেরুচ্ছে না, বাচ্চারা রাস্তায় খেলা করছে ঠিকই।
ইংরিজীতে প্রবাদ আছে, ‘দেবদূত যেখানে যেতে ভয় পান, মূর্খেরা সেখানে চিন্তা না করে ঢোকে।’ এর উল্টোটাও ঠিক। মৃত্যুভয় শুধু মূর্খের, তাই বয়স্করা বেরুচ্ছে না। বাচ্চারা দেব-শিশু, তারা নির্ভয়ে খেলছে। যেটা খেলছে সেটা শুধু এই সময়েই এবং শীতের দেশেই সম্ভব। কবুলের অষ্টাবক্রপৃষ্ঠ রাস্তার জায়গায় জায়গায় জল জমে যায়— সে কিছু নূতন কারবার নয়—সেই জমা জল ফের জমে গিয়ে বরফ হয়ে দিব্য স্কেটিং-রিষ্ক হয়ে দাঁড়ায়। সাবধানী পথিকও সেখানে পা হড়কে দড়াম করে আছাড় খায়। বাচ্চাদের সেইটেই স্বর্গপুরী। অন্যত্র বলেছি, কাবুলীরা পায়জারে শত শত লোহার পেরেক ঠুকে নেয় বলে তার তলাটা সবসুদ্ধ জড়িয়ে মড়িয়ে হয়ে যায় পিছল। বাচ্চারা শুকনো মাটিতে একটুখানি দৌড়ে এসে সেই বরফের উপর নিজেকে ব্যালান্স করে সামনের দিকে একটু ভর দেয় এবং সাঁই করে বরফের অপর প্রান্তে পৌঁছে যায়। আমরা দেশে যে রকম নদীর ঢালু পাড়েতে জল ঢেলে সেটাকে পিছল করে সুপুরীর খোল দিয়ে আসন বানিয়ে হড়হড় করে নিচে নেমে যাই।
মাঝে মাঝে দেউড়ির মুখে দাঁড়িয়ে কোনও কোনও মা ছেলেকে গালিগালাজ দিয়ে বাড়ির ভিতরে ডাকে—ত্বআয় পিদর-সুখ্তে—ওরে পিতৃদহ (বাপকে যে পুড়িয়ে মারে), তোর বাপ নির্বংশ হোক—তোর যম বাড়ির ভিতরে না বাইরে? এখনি ভিতরে আয় বলছি।