দেহ তখন আর লায়লীর সৌন্দর্য ধরে রাখতে পারছে না। ওষ্ঠাধর বিকশিত হয়ে ডেকে এনেছে প্রথম ঊষার নীরব পদক্ষেপে গোলাপী আলোর অবতরণ। তারই দুপাশে শুভ্র শর্করার মত তার বদন ইন্দুর বর্ণচ্ছটা, কিন্তু কপোল দুটির লালিমা হার মানিয়েছে বর্ষা শেষের রক্তাক্ত সূর্যাস্তকে। রক্ত কপোল আর শূভ্র বদনপ্রান্তের মাঝখানে একটি কজ্জলকৃষ্ণ তিল, যেন হাবশী বালক লাল গালের গোলাপ বাগানের প্রান্তদেশে খুলেছে শুভ্র শর্করার হাট। সে বালক তৃষিত। তারই পাশে লায়লীর গালের টোলটি। সে যেন আব্-ই-হায়াৎ, অম্তবারির কূপ-অতল গভীর হতে উৎসারিত হচ্ছে অমৃতসুধা। স্মিত হস্যের সামান্যতম নিপীড়নে উৎসমূলে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয় তারই সৌন্দর্য প্লাবিত করে দেয় তার গুল-বদন, ফুল্ল বল্লরী। সমুদ্রকুমারীর চোখের জল জমে গিয়ে সমুদ্রগর্ভে আশ্রয় নেয় যে মুক্তা সে-ই এসে আলোর সন্ধান পেয়েছে লায়লীর ওষ্ঠাধরের মাঝখানে। সে ওষ্ঠে আমন্ত্রণ, অধরের প্রত্যাখ্যান-মজনুঁর ওষ্ঠাধর যেদিন এদের সঙ্গে সম্মিলিত হবে সেদিন হবে এ রহস্যের চুড়ান্ত সমাধান।
তরুণ রাজপুত্র কয়েস দূর হতে প্রথম দর্শনেই অভিভূত হয়ে আকুলি-বিকুলি করে কি ভাব প্রকাশ করতে চেয়েছিল সে তার বাল্যসখাও বুঝতে পারে নি। সর্পদষ্টাতুরকে আত্মজন যে রকম স্বগৃহে নিয়ে আসে, সখা সেইরকম কয়েসকে নিয়ে গেল আপন দেশে।
অন্তঃপুরবাসিনী অসূর্যম্পশ্যা লায়লীকে প্রেমের পুকার, হৃদয়ের আহ্বান পাঠাবে কয়েস কি করে?
এখানে এসে শব্নম যে কাহিনী বর্ণনা করল তার সঙ্গে আমাদের নল-দময়ন্তী কাহিনীর প্রচুর সাদৃশ্য আছে। পার্থক্য শুধু এইটুকু যে হৃদয়ের কন্দর্পভর ধারণে অসমর্থ নলরাজ কুসুমায়ুধের অগ্রদূত রূপে পাঠিয়েছিলেন বন্য-হংসকে, আর শব্নমের কাহিনীতে কয়েস লায়লীর নবশ্যামদূর্বাদল-বক্ষতলে পালিত কপোতকে বন্দী করে তার ক্ষীণপদে বিজড়িত করে পাঠিয়েছিল প্রেমের লিখন।
কি উত্তর দিয়েছিল লায়লী? কে জানে? কিন্তু আরব ভূমিতে আজও তাবৎ দরদী-হিয়া, শুষ্ক-হৃদয়, সবাই জানে, সেই দিন থেকে লায়লীর চোখে দেখা দিল এক অদ্ভুত জ্যোতি-ক্ষণে ক্ষণে কারণে অকারণে তার চোখে হিল্লোলিত হতে লাগল এক অদৃষ্ট-পূর্ব বিদ্যুল্লেখা।
রাজপ্রাসাদ থেকে যে দেওদার সারি চলে গেছে মরুভূমির প্রত্যন্ত প্রদেশ পর্যন্ত তারই শেষে ছিল ঝরনা ধারা। এ দেওদার সুদূর হিমালয় থেকে আনিয়েছিলেন লায়লীর এক পূর্বপুরুষ। কিংবদন্তী বলে, শস্যশ্যামল-সজল বনভূমির শিশু দেবদারু একমাত্র তাঁরই সোহাগ মাতৃস্তন্য পেয়েছিল বলে এই অস্থিশুষ্ক থরভূমিতে প্লবঘন বীথিকা নির্মাণ করতে পেরেছিল।
আর সেই ঝরনার জল আনতে যেত নগরীকার কারীগণ।
যুগ যুগ ধরে তরুণ প্রেমিকা দেওদার গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে বেণু রবে, কখনও বা গানে গানে প্রেমের আহ্বান পাঠিয়েছে প্রেমিকাকে।
দেবদারু অন্তরালে মরুভূমির সুদূর প্রান্তে ধীরে ধীরে উঠেছে পূর্ণচন্দ্র। দীর্ঘ দেবদারুর ছায়ায় ছায়ায় যেখানে আলোছায়ার কম্প্রমান বেপথু আলিঙ্গন তারই পাশে গা মিশিয়ে দিয়ে মজনূঁ উদ্বাহু হয়ে ধীরে স্থির কষ্ঠে লায়লীকে আহ্বান জানাচ্ছে অদৃশ্য গীতাঞ্জলি স্তবকে স্তবকে নিবেদন করে।
এ আহ্বান জনগণের সুপরিচিত কিন্তু আজ সন্ধ্যার এ আহ্বান যে রহস্যময় মন্ত্রশক্তি নিয়ে বসন্ত সমীরণের চঞ্চলমুখরতা মৌন করে দিল, দেবদারুপল্লবদল স্তম্ভিত করে দিল সে যেন ইহলোকবাসী মর মানবের ক্ষণমুখর হৃৎপিণ্ড স্পন্দনজাত নয়। গৃহে গৃহে বাতায়ন বন্ধ হল। হর্ম্যশিখর থেকে নাগর নাগরী দ্রুতপদে গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করল। বৃদ্ধেরা মক্কার উদ্দেশে মুখ করে আকাশের দিকে দুহাত তুলে প্রার্থনায় রত হলেন।
কার ওই ছায়াময়ী অশরীরী দেহ? কার হৃদয় ছুটে চলেছে দেহের আগে আগে ওইখানে, যেখানে ঊর্ধ্বে উচ্ছ্বসিত উৎসধারা বিগলিত আলিঙ্গনে সিক্ত করে দিচ্ছে দেবদারুদ্রুমকে?
চৈতন্যের পরপারে জরামর অন্তহীন আলিঙ্গন।
বেহেশৎ ত্যাগ করে ফিরিশতাগণ তাঁদের চুম্বনের মাঝখানে এসে আপন চিন্ময়রূপ বিগলিত করে দিলেন।
সংস্কারমুক্ত জনও প্রিয়াসহ তাজমহল দর্শনে যায় না। যমুনা পুলিনের কিংবদন্তী বলে, হংস-মিথুন পর্যন্ত বৃন্দাবন বর্জন করে-তাজমহলের উৎসজল এক সঙ্গে পান করে না। যমুনা বিরহের প্রতীক। অপিচ, বাসরঘর প্রথম মিলনকে চিরজীবী করে রাখতে চায়। সেখানে বিরহগাথার ঠাঁই নেই। শব্নম অতি সংক্ষেপে ক্ষীণ কাকলিতে লায়লী মজনূঁর সে কাহিনী ছুঁয়ে গেল-কনিষ্ঠা যে রকম ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার দিনে তার কনিষ্ঠতম ভীক অঙ্গুলি দিয়ে গ্রামভারি সর্বাগ্রজের কপালে তিলক দেয়।
বর্ষাভোরের ঘন মেঘ হঠাৎ কেটে গেলে যে রকম শত শত বিহঙ্গ বনস্পতিকে মুখরিত করে তোলে ঠিক সেই রকম অকস্মাৎ বিচ্ছুরিত হল শব্নমের আনন্দ গান।
মর্ত্যের ধূলার শরীর আর মৃত্যুঞ্জয় প্রেমকে ধরে রাখতে পারল না। দ্বিগলয়প্রান্ত থেকে যে রামধনু উঠেছে মধ্য-গগনের স্বর্গদ্বার প্রান্ত পর্যন্ত তারই উপর দিয়ে হাত ধরাধরি করে লায়লী মজনূঁ চলেছে অমর্ত্যলোকে। কখনও গহন মেঘমায়া, কখনও তরল আলোছায়ার মাঝে মাঝে, কখনও চূর্ণ স্বর্ণরেণু সূর্যরশ্মি কণা আলোড়িত করে, কখনও ইন্দ্রধনুর ইন্দুনিভ বর্ণাবন্যায় প্রবাহমান হয়ে তারা পৌঁছল স্বর্গদ্বারে। জয়ধ্বনি বেজে উঠেছে বেহেশতের আনন্দাঙ্গানে। পরিপূর্ণ প্রণয়-প্রতীক স্বর্গ হতে দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর সেখানে প্রত্যাবর্তন করছে অনিন্দ্য, নবজন্ম নিয়ে, মরজীবনের জীর্ণ বাস ত্যাগ করে, সুরলোকের অসম্পূর্ণতা সর্বশ্রীময় করে দিতে।