দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে, তার মানে তুমি আমাকে বেশী ভালবাস। তাঁকে অবিশ্বাস করি কি করে? চোখের রোশনী নেই বলে তিনি হৃদয় দেখতে পান।
আমার আহ্লাদের দুকূল প্লাবিত হয়ে গেল। শব্নমকে বুকে ধরে বললুম, বন্ধু, তোমার ক্ষুদ্রতম দীর্ঘনিশ্বাস আমাকে কাতর করে। কিন্তু এখন যে দুশ্চিন্তায় তুমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে সেটা দীর্ঘতম হোক।
কান্না হাসিতে মিশিয়ে বললে, আমি স্বামীসোহাগিনী।
কাবুল নদরী, ওপারে সার-বাধাঁ পল্লবহীন দীর্ঘ তন্বঙ্গী চিনার গাছের দল দাঁড়িয়ে আছে বরফে পা ডুবিয়ে। যেন নগ্ন গোপিনীর দল হর্ম্যসারির পশ্চাতে লুক্কায়িত রাধামাধব চন্দ্রের কাছ থেকে বস্ত্র ভিক্ষা করছে। তাদের ছায়া দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর হতে লাগল। চন্দ্রাভা পাণ্ডুর।
‘এ কি?’ বলে উঠল হঠাৎ হিমিকা। ‘এ কি? এদিকে বলছি স্বামীসোহাগিনী, ওদিকে তার আরাম সুখের খেয়ালই নেই আমার মনে। তোমার ঘুম পায় নি?’
আমি বললাম, না তো! তোমার?
আমার মনে হচ্ছে, আমি যেন সমস্ত জীবন ঘুমিয়ে এইমাত্র জেগে উঠলুম।
উঠে গিয়ে আলমারি খুলে আমার জন্য পাজামা কুর্তা নিয়ে এল। বললে, দেখ দিকি মোটামুটি ফিট হয় কি না। আমি আন্দাজে সেলাই করেছি।
গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে গেল, ‘আমি তাকে নিয়ে যাব, আমার মায়ের বাড়ীতে। মা আমায় শিখিয়ে দেবে। আমি তাকে পান করতে দেব সুগন্ধি মদিরা-আমারই ডালিম নিংড়ে বের করা রসের সুরভি মদিরা। তার বাম হাত রইবে আমার মাথার নিচে আর তার ডান হাত দিয়ে সে আমায় আলিঙ্গন করবে। আমার অনুরোধ, আমার আদেশ, অয়ি জেরুজালেম-বালা-দল আমার প্রেমকে চঞ্চলিত করো না, তাকে জাগ্রত করো না, যতক্ষণ সে না পরিতৃপ্ত হয়। ….আমি তাকে নিয়ে যাব আমার মায়ের ঘরে—যে ঘরে আমাকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন। আমি তাকে পান করতে দেব আমারই ডালিম নিংড়ে—’
চার হাজার পাঁচ হাজার বৎসরের পুরাতন বাসর-রাতি গীতি।
পুরাতন!
২.৮ তপ্ত শয্যায় শবনমের গায়ে ঈষৎ শিহরণ
তপ্ত শয্যায় শব্নমের গায়ে ঈষৎ শিহরণ। অচ্ছেদ সরসী নীরে রমণীর কম্পন?
মোতির মালাটি গলাতেই আছে। আমি সেটি দানা দানায় অল্প অল্প ঘোরাতে ঘোরাতে একটা লকেটে হাত ঠেকল। বললুম, এর ভিতরে কিছু আছে?
চুপ।
আমি মালা ঘোরানো বন্ধ করে তার বুকের উপর হাত রেখে চুপ করে রইলুম।
হঠাৎ লেপ সরিয়ে উঠে পড়ল ঘরের কোণের অতিশয় ক্ষীণ শিখাটির দিকে। আমি দেখতে পেলুম, যেন ঝরে উড়ে গেল একটি গোলাপ ফুল, তার দীর্ঘ ডাঁটাটির চতুর্দিকে আলুলায়িত, হিল্লোলিত অতি সূক্ষ্ম, অতি ফিকে গোলাপী মসলিন। ক্ষীণালোকে তার প্রতিটি অঙ্গ দেখা যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছেও না।
আলো জোর করে দিয়েছে। এখন প্রতি অঙ্গ-। আমি চোখ বন্ধ করলুম।
আমার পাশে শুয়ে লকেটটি খুলে আমার হাতে তুলে দিয়ে বললে, এই আমার শেষ গোপন ধন। এবারে আমি নিশ্চিন্ত হব।
খুলে দেখি আমারই একটি ছোট্ট ফটো! অবাক হয়ে শুধালুম, ‘এ তুমি কোথায় পেলে?’
বললে, চোখের জলে নাকের জলে।
‘সে কি?—এতদিনে বুঝলুম, শব্নম কেন কখনও আমার ছবি চায় নি।’
আব্বা ইংরেজী কাগজ নেন—হিন্দুস্থানী। জশ্নের কয়েকদিন পরে তারই একটাতে দেখি পরবের সময় ব্রিটিশ লিগেশনে আর কাবুল টীমে যে ক্রিকেট ম্যাচ হয়েছিল তারই খান দুই তিন ফটো। কান্দাহার থেকে লিখলুম ওই কাগজকে ছবিটার কন্টাকট্ প্রিন্ট পাঠাবার জন্য। মূল্যস্বরূপ পাঠালুম, এ দেশের কয়েকখানা বিরল স্ট্যাম্প-বিদেশে পয়সা পাঠানো যে কী কঠিন সেই জ্ঞান হলো চোখের জলে নাকের জলে! সন্ত্বনা এই, যে লোকটার হাতে চিঠিখানা পড়েছিল সে নিশ্চয়ই স্ট্যাম্প বোঝে। আমাকে অনেক আবোল তাবোল ছবির মাঝখানে ওই ছবিও পাঠালে খান তিনেক। তোমার ছবি তুলে নিয়ে লকেটে পুরে দিলুম। হল?
আমি কি বলব? আমি তার মুক্তামালা রুদ্রাক্ষের শেষ প্রান্তের ইস্টমন্থ!
দিনযামিনী সায়ন্প্রাতে শিশির বসন্তে বক্ষলগ্ন হয়ে এ শুনেছে শব্নমের আকুলতা ব্যাকুলতা প্রতি হৃদয়স্পন্দনে। একে সিক্ত করে রেখেছে শব্নমের অসহ্য বিরহশর্বরীর তপ্ত আঁখিবারি।
আমি কল্পনা করে মনে মনে সে ছবি দেখছি, না শব্নম কথা বলেছে? দুটোর মাঝখানে আজ আর কোনও পার্থক্য নেই। কিংবা তার না-বলা ব্যথা যেন কোন্ মন্ত্রবলে শব্দতরঙ্গ উপেক্ষা করে তার হৃদস্পন্দন থেকে আমার হৃদস্পন্দনে অব্যবহিত সঞ্চারিত হচ্ছে। কান্ঠাশ্লেষে বক্ষালিঙ্গনে চেতনা চেতনায় এই বিজড়ন অন্য রজনীর তৃতীয় যামে আমা দোহাকার জ্যোতির্ময় অভিজ্ঞান, অপূর্বলব্ধ বৈভব।
কত না সোহাগে কত না গান গুনগুন করে শব্নম সে রাত্রে আমাকে কানে কানে শুনিয়েছিল। লায়লী মজনূঁর কাহিনী।
বাঙালী কীর্তনিয়া যে রকম রাধামাধবের কাহিনী নিবেদন করার সময় কখনও চণ্ডীদাস, কখনও জগদানন্দ, কখনও জ্ঞানদাস, কখনও বলরাম দাস, বহু পূষ্প থেকে মধু সঞ্চয় করে অমৃতভাণ্ড পরিপূর্ণ করে, শবনম্ ঠিক তেমনি কখনও নিজামী, কখনও ফিরদৌসী, কখনও জামী, কখনও ফিগানী থেকে বাছাই গান বের করে তাতে হিয়ার সমস্ত সোহাগ ঢেলে দিয়ে আমাকে সেই সুরলোকে উড়িয়ে নিয়ে গেল যেখানে সে আর আমি শুধু দুজনা, যেখানে কপোতী কপোতকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় ঊধ্বর্তর গগনাঙ্গনে।
কপোত-কপোতী দিয়েই সে তার কীর্তন আরম্ভ করেছিল। বয়ঃসন্ধিক্ষণে মুকুলিকা লায়লী পুষেছিল কপোত-কপোতী। যৌবন দেহলিপ্রান্তে সে কপোত-কপোতীকে দেখে আধো আধো বুঝতে শিখলে প্রেমের রহস্য।