‘তাই যখন তোমাকে প্রথম দেখলুম তখন আপন চোখকে বিশ্বাস করতে পারি নি।’
‘আমি আমার হৃদয়ে ঝাপসা ঝাপসা যে স্কেচ এতদিন ধরে এঁকেছিলুম এ যেন হঠাৎ ভাস্করের হাতে পরিপূর্ণ নির্মিত মূর্তি হয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। চিন্ময় মৃদু সৌরভ যেন মৃন্ময় নিকুঞ্জবনের কুসুমদামে রূপান্তরিত হল।’
‘টেনিস কোর্টে তাই অত সহজে তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারছিলুম কিন্তু সমস্তক্ষণই ভাবছিলুম অন্য কথা—’
‘মৃন্ময় চিন্ময় হয় সে আমি জানি। কি যেন এক ফলের কয়েক ফোঁটা রসকে শুকিয়ে তাতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে করা হল ধুঁয়ো। তারই আড়াই পাক মগজের সেল্কে আলতো আলতো ছুঁতে না ছুঁতেই পথের অন্ধ ভিখারী দেখে, সে রাজবেশ পরে শুয়ে আছে বেহেশ্তের হুরীর স্ত্রীর কোলে মাথা দিয়ে। প্রণয়পীড়ায় ব্যথিত আতুর ক্রন্দসী-প্রেয়সী হুরীরাণী তারই দিকে তাকিয়ে আছে, করুণ নয়নে, পথের ভিখারীর মত, যেন অভাগিনীর প্রেম-নিবেদন পদদলিত না হয়!’
‘অতদূর যাই কেন, আর এ তো নেশার কথা।’
‘একটি অতি ক্ষুদ্র তুচ্ছ কালো তিল। শীরাজবাসিনী তুর্কী রমণী সাকীর গালে সেইটি দেখে হাফিজ মুহুর্তেই তার বদলে সমরকন্দ্ আর বুখারা শহর বিলিয়ে দিয়ে ফকীর হয়ে গোরস্তানে গিয়ে বসে রইলেন।’
‘কিন্তু চিন্ময় মৃন্ময় হয় কি করে?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, বুঝেছি, বুঝেছি। পরে বুঝেছি, আরও ভালো করে, মর্মান্তিকরূপে কান্দাহারে। আমার হৃদয়বেদনা তো সম্পূর্ণ চিন্ময়। তারই পেয়ালা যখন ভরে যায় তখন সে উপছে পড়ে আঁখি বারি রূপে। তুমি সুন্দর বলেছ, ‘আকাশের জল আর চোখের জল একই কারণে ঝরে না’; ‘আমি তাতে যোগ দিলুম—তাদের উপাদানও সম্পূর্ণ আলাদা, একটি মৃন্ময় আরেকটা চিন্ময়, একটা বাঙ্ময়-সারা আকাশ মুখর করে তোলে, আরেকটা নৈস্তন্তে বিরাজ করে সর্ব মনময়।
আমি স্থির করেছিলুম, কিছু বলব না। শব্নমের আত্মপ্রকাশের আকুবাকু আমার স্পর্শকাতরতাকে অভিভূত করে দিলে। আস্তে আস্তে বললুম, আমার এক কবি বলেছেন, তুমি আমার প্রিয়, কারণ—“আমার হিয়ার ভিতর হৈতে কে কৈল বাহির?”
বললে, সুন্দর বলেছেন। কিন্তু আজ আমি কবিতার ওপারে।
‘বিশ্বাস করবে না, ডানস্ হলের সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় তোমাকে ভালো করে না দেখে হোটেলের বেয়ারা ভেবে যখন হুকুম দিয়েছিলুম, গাড়ি আনতে, তখনও ভেবেছিলুম এ কি রকম বেয়ারা-এর তো বেয়ারার বেয়ারিঙ নয়—ভালো করে তাকিয়ে দেখি, আজ পর্যন্ত যত মানুষ দেখেছি, যত বর্ণনা পড়েছি, যত ছবি দেখেছি এর বেয়ারিঙ তো তাদের একটার সঙ্গেও মিলছে না। তারপর কে যেন আমার বুকের ভিতরে ছবির খাতা মোচড় মেরে মেরে পাতার পর পাতা খুলে যেতে লাগল—তাতে ব্যথা-কিন্তু কি আনন্দ—এক এক বার তোমার দিকে তাকিয়ে দেখি আর ছবির দিকে তাকাই-কী অদ্ভুত—হুবহু মিলে যাচ্ছে। পথে যেতে যেতে, তোমার বাহুতে যখন আমার বাহু ঠেকল, খেলার জায়গায়, নদীর পাড়ে, তোমার ঘরে-এখনও দেখেই যাচ্ছি, দেখেই যাচ্ছি, এ দেখা আমার কখনও ফুরবে না। যেমন যেমন পাতা মিলিয়ে দেখছি, সঙ্গে সঙ্গে আরও নয়া নয়া তসবীর আঁকা হয়ে যাচ্ছে।’
হঠাৎ সে হাঁটু গেড়ে আমার দুই জানু আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে কাতর কণ্ঠে বললে, ওগো, তুমি কেন ভাব, তুমি অতি সাধারণ জন? তোমার ঐ একটিমাত্র জিনিসই আমার বুকের ভিতর যেন ঝড় এসে আমার বুকের বরফ ধুনরীর মত তুলো-পেঁজা করে দেয়। আমার অসহ্য কষ্ট হয়। তুমি কেন আমার দিকে আতুরের মত তাকাও, তুমি কেন তোমার যা হক্ক তার কণাটুকু পেয়েও ভিখারীর মত গদগদ হও? তুমি কেন বিয়ের মন্ত্রোচ্চারণে শেষ হতে না হতেই সদম্ভে কাঁচি এনে আমার জুল্ফ কেটে দাও না, তুমি কেন আমার মুখের বসন দুহাত দিয়ে টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেল না-সিংহ যে রকম হরিণীর মাংস টুকরো টুকরো ছিড়ে ছিড়ে খায়?
আমি নির্বাক।
চাঁদ বহুক্ষণ হল বাড়ির পিছনে আড়াল পড়েছে। আবছায়াতেও শব্নমের চোখ জ্বলজ্বল করছে।
হঠাৎ মধুর হেসে সুধীরে তার মাথাটি আমার জানুর উপর রেখে বললে, না, গো, না। সেইখানেই তো তুমি। তোমার অজনাতে তোমার ভিতর একজন আছে যাকে আমি চিনি। সে বলে, “আমার যা হক্কের মাল আমার কাছে তাই এসেছে—আমার তাড়া কিসের?” আর জান, তুমিই একমাত্র লোক যে আমার প্রতি মুহুর্তে কবিতা উদ্ধৃতি শুনে কখনও শুধায় নি, তুমি বাস্তবে বাস করো, না, কাব্যলোকে? তুমিই একমাত্র যে বুঝেছে যে কাব্যলোকে বাস না করলে বাস কি করব ইতিহাসলোকে, না দর্শনলোক, না ডাক্তারদের ছেঁড়া-খোঁড়ার শবলোকে? আর এ সব কোনও লোকেই যদি বাস না করি তবে তো নেমে আসবও সেই লোকে-গাধা গরু যেখানে ঘাস চিবোয় আর জাবর কাটে।
কিন্তু এ কিছু নয়, কিছু নয়। আল কথা, সে তোমার মৃত্যুঞ্জয় প্রেম। আমি সুজাতা, সুচরিতা, সুস্মিতা আর আমার প্রেম যেন নব বসন্তের মধু নরগিস-তোমার প্রেম ভরা-নিদাঘের বিরহরসঘন দ্রাক্ষাকুঞ্জ। তারই ছায়ায় আমি জিরবো, তারই দেহে হেলান দিয়ে আমি বলব, সেই আঙুর আমি জিভ আর তালুর মাঝখানে আস্তে আস্তে নিষ্পেষিত করে শুষে নেব। এই যে রকম এখন করছি।
আমার মুখ কাছে টেনে নিল।
তারপর হঠাৎ হেসে উঠে শুধালে, বল দেখি, মেয়েরা অনেকক্ষণ ধরে চুমো খেতে পারে না কেন?
‘কি করে বলব বল।’
দুমিনিট মুখ বন্ধ করে থাকতে পারে না বলে। কথা কইতে ইচ্ছে যায়। আর শোন, জানেমন্ আমাকে ডেকে কি বললে, জান? বললে, তুমি নাকি আমার আঁধার ঘরের অনির্বাণ বিজলি। তোমার বুকের ভিতর নাকি বিদ্যুৎবহ্নি। আমরা একশ বছর বাঁচলেও নাকি তোমার প্রেম ক্ষণে ক্ষণে চমক দিয়ে আমাকে নিত্য নবীন করে রাখবে। আর চেয়ে মারাত্মক কথা কি বলেছে, জান? বলেছে, আমি যেন তোমার কাছ থেকে ভালবাসতে শিখি।