‘আমার লাগা না-লাগাতে কি? আমি তো বিদেশী।’
‘বিদেশী হলেও প্রতিবেশী তো। আমি ফ্রান্স থেকে ফেরার সময়-’
আমি অবাক হয়ে শুধালুমম, ‘ফ্রান্স থেকে-?’
‘ইংরেজের কল্যাণে বাবাকে নির্বাসনে যেতে হয়। আমার জন্য প্যারিসে। সেখানে দশ বছর আর এখানে ন’বছর কাটিয়েছি। যাকগে সে-কথা। দেশে ফেরার সময় বোম্বাই পেশাওয়ার হয়ে আসি। দাঁড়ান, ভেবে বলছি। ঠিক এই আগষ্টেই আমরা এসেছিলুম। সে কী বৃষ্টি, বৃষ্টি আর বৃষ্টি! বোম্বাই থেকে লাহোর পর্যন্ত। ঝপঝপ ঝুপঝাপ। গাড়ির শব্দের সঙ্গে মিলে গিয়ে চমৎকার শোনায়। তা সে যাকগে। কিন্তু ওই বোম্বাই থেকে এই পেশাওয়ার-এর সঙ্গে তো ফ্রান্সের কোনো মিল নেই। মিল আফগানিস্থানের সঙ্গে। দুটোই সুন্দর দেশ। আর ভারতবর্ষ সম্বন্ধে ইরানী কবি কি বলেছেন, জানেন?
‘হাফিজ যেন কি বলেছেন?’
না। আলীকুলী সলীম বলেছেন:
“নীস্ত দর ইরান জমীন সামান-ইতহসীল কামাল
তা নিয়ামদ হিন্দুস্তান হিনা রঙ্গীন ন শুদ।”
“পরিপূর্ণতা পাবে তুমি কোথা ইরান দেশের ভূয়ে
মেহদির পাতা কড়া লাল হয় ভারতের মাটি খুঁয়ে।”
আমি শুধলুম, এদেশের হেনাতে কি কড়া রঙ হয় না?
বাজে। ফিকে। হলদে।
আমি বললাম, আপনি কথায় কথায় এত কবিতা বলতে পারেন কি করে?
হেসে বললে, বাবা আওড়ান। আর ন দশ বছরেও আমার আত্মসম্মান জ্ঞানটি ছিল অত্যুগ্র। প্যারিসে ক্লাসে ফারসী কবিতা কেউ আওড়ালে আমি সঙ্গে সঙ্গে ফার্সী শুনিয়ে দিতুম।
তারপর বললে, ‘বড় রাস্তায় তো জন-মানব নেই। শুধু মনে হচ্ছে একখানা মোটর বার বার আসা-যাওয়া করছে। নয় কি? আপনি লক্ষ্য করেছেন?’
আমি বললাম, “বোধ হয় তাই।”
বললে, ‘তবে আমাকে বলেন নি কেন?’
আমি এক-মাথা লজ্জা পেয়ে বললুম, ‘আমার ভালো লাগছিল বলে।’
মেয়েটি চুপ করে রইল।
আমি শুধালাম, ওটা কি আপনাদের গাড়ি? আপনাকে খুঁজছে?
‘উঁ।’
তবে চলুন।
না।
‘আচ্ছা। কিন্তু আপনার বাড়ির লোক আপনার জন্য দুশ্চিন্তা করবেন না?’
‘তবে চলুন।’ উঠে দাঁড়াল।
আমি বললুম, শব্নম বানু আমাকে ভুল বুঝবেন না।
‘তওবা! আপনাকে ভুল বুঝব কেন?’
রাস্তায় যেতে যেতে বেশ কিছু পরে সেই কথার যেই ধরে বলল, বিদেশীর সঙ্গে আলাপ করতে ওই তো আনন্দ। তার সম্বন্ধে কিছু জানি নে। সেও কিছু জানে না। সেই যে কবিতা আছে,
“মা আজ আগাজ ওয়া আনজামে জাহান কেরীম
আওওল ও আখিরুই-ঈন তূহনে কিতাব ইফতালে অসৎ।”
“গোড়া আর শেষ এই সৃষ্টির জানা আছে, বলো, কার?
প্রাচীন এ পুঁথি গোড়া আর শেষে পাতা কটি ঝরা তার।”
এমন সময় সেই জ্বলজ্বলে আলোও পোড়ামুখো মোটর এসে সামনে দাঁড়াল। শব্নম বানু বললে, ‘চলুন, আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দি।’
এতক্ষণ দুজনাতে বেশ কথাবার্তা হচ্ছিল। এখন ওই ড্রাইভারের সামনে কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করতে লাগলুম। প্যারিস থেকে এসে থাক, আর খাস কাবুললীই হোক, এরা যে কট্টর গোড়া সে কি কারো অজানা? বললুম, ‘থাক। আমার হোটেল কাছেই।’
শব্নম বানু বুদ্ধিমতী। বললে, ‘বেশ। তবে, দেখুন আগা, আপনি কোনো কারণে কণামাত্র সঙ্কোচ করবেন না। আমি কাউকে পরোয়া করি না।’
পরোয়া শব্দটি আসলে ফার্সী। শব্নম ওই শব্দটিই ব্যবহার করেছিল।
‘আদাব আরজ।’
‘খুদা হাফিজ।’
হোটেলে ঢোকবার সময় পিছনে শব্দ হওয়াতে তাকিয়ে দেখি আবদুর রহমান। নিজের থেকেই বলল, একটু বেড়াতে গিয়েছিলুম।
আমি তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলুম ইনি একটি হস্তীমূর্খ না মর্কটচুড়ামণি?
সমস্ত রাত ঘুম এল না।
জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি আদম-সুরৎ-কালপুরুষ। অতি প্রসন্ন বদনে যেন আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আকাশের পরিপূর্ণ শান্তি যেন তার অঙ্গের প্রতিটি তারায় সঞ্চিত করে আমার দিকে বিচ্ছুরিত করে পাঠাচ্ছেন।
একটি ফার্সী কবিতা মনে পড়ল।
ইরানের এক সভাকবি নাকি চাড়ালদের সঙ্গে বসে ভাড়ে করে মদ্যপান করেছিলেন। রাজা তাই নিয়ে অনুযোগ করাতে তিনি বলেছিলেন,
“হাজার যোজন নিচেতে নামিয়া আকাশের ওই তারা।
গোপদে হল প্রতিবিম্বিত; তাই হল মানহারা?”
শেষরাত্রে কালো মেঘ এসে আকাশের তারা একটি একটি করে নিবিয়ে দিতে লাগল। আমার মন অজানা অস্বস্তিতে ভরে উঠতে লাগল। বিবেকানন্দ ইংরিজী কবিতায় লিখেছিলেন ‘দি স্টার আর ব্লটেড আউট।’ সত্যেন দত্ত অনুবাদ করেছেন নিঃশেষে নিবেছে তারাদল। কেমন যেন, কি হবে একটা ভাব মনকে আচ্ছন্ন করে দিল।
শেষরাত্রে নামল খাঁটি সিলেটি বৃষ্টি।
প্রসন্নাস্ত, প্রসন্নাস্ত আমার অদ্য সন্ধ্যার সবিতার!
খুদাতালা বেহদ মেহেরবান। আমার শেষ মনস্কামনা পূর্ণ করে দিলেন। কী মূর্খ আমি! আমার প্রত্যাশা যে করুণাময়ের অফুরন্ত দান ছাড়িয়ে যেতে পারে, এ-দম্ভ আমি করেছিলুম কোন্ গবেটামিতে?
১.২ ঘুম-ভাঙা-ঘুম লাগা কল্পনা-স্বপ্নে-জড়ানো
ঘুম-ভাঙা-ঘুম লাগা কল্পনা-স্বপ্নে-জড়ানো রাতের শেষ হল সূর্যোদয়ের অনেক পর। কাল রাত্রে তো পারিই নি, আজ সকালেও বুঝতে পারলুম না, কাল রাত্রে কি হয়ে গেল। এ কি আরম্ভ, না এই শেষ! এ কি অন্ধকার রাত্রে চন্দ্রোদয়ের মত আমার ভূবন প্রসারিত করে দেবে, না এ হঠাৎ চমক-মারা বিদ্যুল্লেখা শুধু ক্ষণেকের তরে সুদূর আকাশপটে আমার ভাগ্যের ব্যঙ্গচিত্র এঁকে লোপ পাবে!
আচ্ছন্নের মত জানালার ধারের টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল চেয়ারে ঝোলানো আমার কোটের ধের উপর এক গাছি লম্বা চুল।