‘আব্বাজান কোথায়?’
‘দুর্গে। আমানুল্লাকে মন্ত্রণা দিচ্ছেন। ট্যুব থেকে বেরিয়ে আসা ফালতো টুথপেস্ট ফের ভিতরে ঢোকাবার চেষ্টা করছেন।’
তোপল্ খান?
‘লড়াইয়ে।’
‘তুমি কি করে এলে?
‘রেওয়াজ করে করে। ধোপানীর তাম্বুটা যোগাড় করে প্রথম প্রথম কাছেপিঠে বান্ধবীদের বাড়িতে ওদের তত্ত্ব-তাবাশ করতে গেলুম।’
একটু থেমে বললে, আচ্ছা বল তো, তোমাকে ভালোবাসার পর থেকে আমি ওদের কথা একদম ভুলে গিয়েছি। আমার যে সব সখীদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে তারাও আমাকে স্মরণ করে না। অথচ শুনেছি, পুরুষ মানুষরা নাকি বিয়ের পর সখাদের অত সহজে ভোলে না? মেয়েরা তাহলে বেইমান, নেমকহারাম?
আমি বললুম, গুণীরা বলেন, প্রেম মেয়েদের সর্বস্ব, পুরুষের জীবনের মাত্র একটি অংশ। তাই বোধ হয় মেয়েরা ওই রকম করে। কিন্তু, আমার মনে হয়, তা নয়। আমি বিদেশী, আমি অসহায়, আমি নিজের থেকে কোন কিছু করতে গেলেই হয়তো তোমাকে বিপদে ফেলা হবে মাত্র এই ভেবে আমি হাত-পা বাঁধা অবস্থায় কিসমতের কিল খাচ্ছি। তুমি সেটা জান বলে, সর্বক্ষণ তোমার চিন্তা, কি করে আমার সমস্ত দুশ্চিন্তা, আমার বিরহ বেদনা, তোমাকে কাছে পাওয়ার কামনা আপন কাঁধে নিয়ে আর্ত শিশুর মত আদর করে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পার। তোমার সখীরা, আব্বা, জানেমন্ কেউই তো তোমার উপর কোন কিছুর জন্য এতটুকু নির্ভর করছেন না। আর আমি করছি সম্পূর্ণ নির্ভর তোমার উপর। তোমার জিম্মাদারী এখন বেড়ে গিয়েছে। জিম্মাদারী-বোধ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একাগ্রতবোধও বেড়ে যায়।
বললে, সে না হয় তোমার আমার বেলা হল—তুমি বিদেশী বলে।
‘অন্যদের বেলাও তাই। অধিকাংশ দেশেই মেয়ের জন্ম তো পবিারের আপদ। সেই ‘আপদ’ যেদিন এমন একটি লোককে পায়, যাকে ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক বাকী জীবন তার উপর নির্ভর করতে হবে, তখন তার অবস্থা তোমারই মত হয়। কিন্তু আরেকটা কথা। এই একাগ্রতাটা মেয়েদের কিছু একচেটে নয়। লায়লীর জন্য মজনূঁর একাগ্রতাই তো তাকে পাগল বানিয়ে দিলে?’
শুধালে, কোন্ মজনূঁ?
আমি বললুম, তারপর তুমি কি করলে বলছিলে?
‘ওঃ! পাড়ার সখীদের বাড়ি গিয়ে প্র্যাকটিস্ করলুম।’
আমি বললাম, “শ্রীরাধা যে রকম আঙিনায় কলসী কলসী জল ঢেলে সেটাকে পিছলে করে তুলে, বর্ষার রাতে পিছলে অভিসার যাওয়ার প্র্যাকটিস্ করে নিতেন?”
ইরান তুরান আরবভূমির তাবৎ প্রেমের কাহিনী শব্নমের হৃদয়স্থ। তাই আমি তাকে শোনাতুম হিন্দুস্থানী রমণীর বেদনাবাণী। সে সব কাহিনীর রাজমুকুট সুচির অভাগিনী অভিমানিনী শ্রীরাধার চোখের জলের মুক্তো দিয়ে সাজাতে আমার বড় ভালো লাগে। কিন্তু একাধিকবার লক্ষ্য করেছি শব্নম যেন শ্রীরাধাকে ঈষৎ ঈর্ষা করে।
বললে, ‘হুঃ! তোমার শুধু শ্রীরাধা শ্রীরাধা! তা সে যাকগে। তারপর ধোপানীর তাম্বু পরে বেরিয়ে পড়লাম তোমার উদ্দেশ্যে। আমার ভাবনা ছিল শুধু আমার পা দুখানা নিয়ে। ও দুটো বোরকা দিয়ে সব সময় ভালো করে ঢাকা যায় না।’
আমি বললুম, রজকিনী চরণ বাঙলা সাহিত্যের বুকের উপর।
“মানে?”
আমি চোখ বন্ধ করে হিমির পায়ের দিকে হাত বাড়িয়ে মুদ্রিত নয়নে গান ধরলুম,
‘শুন রজকিনী রামী
শীতল জানিয়া ও-দুটি চরণ
শরণ লইনু আমি!
বললে, ‘এ সুরটা সত্যি আমার প্রিয়। এর ভিতর কত মধুর আকুতি আর করুণ আত্মনিবেদন আছে।’
আমি বললুম, আচ্ছা, ‘শীতল চরণ’ কেন বললে, বল তো?
নাক তুলে বললে, “বাঃ! সে তো সোজা। ধোপানী জলে দাঁড়িয়ে কাপড় আছড়ায় তাই।”
জাহাঁবাজ মেয়ে!
বললে, “জান বধুঁ, আজ ভোরবেলার আজান শুনে যখন আমার ঘুম ভাঙল তখন বুকের ভিতরটা যেন একেবারে ঝাঝরা ফাঁকা বলে মনে হল। কিছু নেই, কিছু নেই, যেন কিছু নেই। পেটটাও যেন একেবারে ফাঁপা, যেন দাঁড়াতে পারব না। বুকের ভিতর কি যেন একটা শূন্যতা শুধু ঘুরে ঘুরে পাক খাচ্ছে। সব যেন নিঙড়ে নিঙড়ে নিচ্ছে। ওঠবার চেষ্টা করুলুম, উঠতে পারলুম না। কোমরের সঙ্গে আমার বাকী শরীরের যেন কোন যোগ নেই।”
‘মোয়াজ্জিন তথন বলছে, আস-সালাতু খৈরুম্ মিন্ অন-নওম-’ ‘নিদ্রার চেয়ে উপাসনা ভালো।’
‘আমি কাতর নিবেদনে আল্লাকে বললুম, হে খুদাতালা, তোমার দুনিয়ায় তো কোন কিছুরই অভাব নেই। আমাকে একটুখানি শক্তি দাও।’
আমি অনুনয় করে বললুম, থাক না।
বললে, ‘কাকে তা হলে বলি, বল। জানি, তুমি এ শুনে কষ্ট পাও। কিন্তু তোমাকে কষ্ট দেবার জন্য তো আমি আমার দুঃখের কথা বলছি নে। আবার না বলেও থাকতে পারছি নে। এ কী দ্বন্দ্ব, বল তো?’
আমি বললুম, তুমি বলে যাও। আমার শুনতেও ভালো লাগে যে সর্বক্ষণ আমি তোমার মনের ভিতর আছি। এও তো দ্বন্দ্ব।
তবে শোন, আর শুনেই ভুলে যেয়ো। না হলে আমার বিরহে তোমার বেদনার ভার সেই স্মৃতি আরও ভারী করে তুলবে। নিজে কষ্ট তো পাবেই, তার উপর আমার কষ্টের স্মরণে বেদনা পাবে বেশী।
‘এই যে ফাঁকা ভাব ভোরবেলাকার, এইটে বওয়াই সব চেয়ে বেশী শক্ত।’
‘কে বল সহজ, ফাঁকা যাহা তারে, কাঁধেতে বহিতে সওয়া?
জীবন যতই ফাঁকা যাহা হয়ে যায়, ততই কঠিন বওয়া।’
‘ফাঁকা জিনিস ভারি হয়ে যায়, এর কল্পনা কি আমি কখনও করতে পেরেছি?’
‘কোন গতিকে এই দেহটাকে টেনে টেনে বাইরে এনে নমাজ পড়লুম। হায় রে নামাজ। চোখের জলে বুক ভাসিয়ে দেওয়াকে যদি নামাজ বলে তবে আমার মত নামাজ কেউ কখনও পড়ে নি।