‘জ্ঞান ফিরতে দেখি, আমি মাথা ঝুঁকে বর্ডারের উপর বুলবুলির চোখে তুলি লাগিয়ে বসে আছি।’
আমি চুপ করে শুনে গেলুম।
নিঃশ্বাস ফেলে বললে, “তুমি পুরুষ, তুমি কি করে বুঝবে কুমারীর প্রেম। তুমি তো সমুদ্র-তরঙ্গ, ঝড়ের ঘূর্ণি। আর আমার প্রেম? -স্বপ্নে স্বপ্নে বোনা শুক্তির মুক্তো। কত ছোট আর কত অজানার নিভৃত কোণে তার নীড়। কত আঁখি-পল্লব থেকে নিংড়ে নিংড়ে বের-করা এক ফোঁটা আঁখি জল। আর তার প্রতিটি ক্ষুদ্রতম কণাতে আছে কুমারীর লজ্জা, ভয়, সঙ্কোচ।”
চুপ করে গেল।
আমি কাঁচি হাতে নিয়ে জুল্ফ থেকে তিন গোছা চুল কেটে নিয়ে বললুম, এই মুক্ত করলুম, আমি তোমার লজ্জা, সঙ্কোচ, ভয়।
আগুনের সামনে বসেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল বাইরে শীত কী রকম ঘনিয়ে আসছে। সে শীত যখন তার চরমে পৌঁছেছে তখনও শব্নম তার জুল্ফ কানের পিছনে ঠেলে দিতে দিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে, একি নেমকহারামির চূড়ান্ত নয়-যে বাড়ীতে কুড়িটি বছর কাটিয়েছি সেটা আর নিজের বাড়ি বলে মনে হচ্ছে না? আর এ বাড়ি? এ বাড়ি আসলে তোমার আপন বাড়িও নয়—এ বাড়িতে তো আমার শাশুরি-মা তোমাকে জন্ম দেন নি। তবু মনে হচ্ছে, এ বাড়িতেই যেন শিশুকাল থেকে আমরা খেলাধুলা ঝগড়াঝাটি মান অভিমান করে আজ আমাদের চরম মিলনে পৌঁছলুম।
একটুখানি ভাবলে। তারপর মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে বললে, উহুঁ, এটাও যেন সম্পূর্ণ সত্য নয়। কেমন যেন মনে হচ্ছে, আমরা দুটি শিশু এ বাড়ির আঙিনাতে খেলা করছি, আর ও বাড়ির ছাদে বসে আব্বাজান, জানেমন্ একে অন্যের সঙ্গে গল্প করতে করতে আমাদের দিকে স্নেহদৃষ্টি রেখে সকল বিপদ আপদ ঠেকিয়ে রাখছেন। খেলা ছেড়ে ছুটে গিয়ে একবার জানেমনের কোলে বসে জিরিয়ে আসি।
আমার মোজাটা খুলতে খুলতে বললে, ‘এই যে লাগল গোলমাল, এর শেষ কবে, আর কোথায়, কেউ বলতে পারে না। তোমাকে আবার কখন দেখতে পাব তাও জানি নে। তবে এখন আমার বুক ভরা সান্ত্বনা। ওই বাচ্চা যদি কাল এসে যেত তা হলে আমাকে মহাবিপদে ফেলত। পাগলা-ভিড় ঠেলে এসে তোমাকে বিয়ে করতে হত। এখন আমি নিশ্চিন্ত মনে যাচ্ছি।’
আমি অবাক হয়ে বললুম, এই শীতে? এত রাত্তিরে?
‘এই সময়টাই সবচেয়ে ভাল। ডাকুদের দামী দামী ওভারকোট নেই যে এই শীতে বেরুবে। কাল সকালে দেখবে কাবুলে মেলার ভিড়। চোর ডাকাত বেবাক মৌজুদ। প্রথম লুট আরম্ভ হলেই ওরা সব ঝাঁপিয়ে পড়বে। বাচ্চা তো উপলক্ষ্য মাত্র। তুমি এ দেশের হালহকীকৎ জান অতি অল্প। আমাকে বিশ্বাস করে নিশ্চিন্ত হও।’
আমি সেদিন তাকে বিশ্বাস করেছি। আজও করি।
খুশী হয়ে বললে, ‘এই তো চাই। আমি তোপল্ খানকে ডাকি। তুমি যাও, শুয়ে পড়। কতক্ষণ ধরে এই সুট পরে আছ।’
শীতের দেশ বলে আমি শিলওয়ার, চুড়িদার পাঞ্জাবী পরে শুই।
শোবার ঘরে ঢুকেই বললে, “বাঃ! কী চমৎকার দেখাচ্ছে তোমাকে! কিন্তু এ আবার কি রকমের কুর্তা? দু দিকে চেরা কেন?’ দেখি? হাত ঢুকিয়ে দিয়ে বললে, “ও! পকেট! ভারী অরিজিনাল আইডিয়া তো। হাতে আবার পট্টি করে বোতাম। ও, বুঝেছি, খাবার সময় আস্তিন যাতে ঝোলে ডুবে না যায়। আমিও এরকম একটা করাব। সবাই বলবে, ‘আমি কি অরিজিনাল। এবারে তুমি শোও দিকি নি।’
তিন দিকে লেপ গুঁজতে গুঁজতে বললে, তুমি কণামাত্র দুশ্চিন্তা করো না। তোপল্ খান একটা সার্ভে করে এসেছে। আমার কথাই ঠিক। রাস্তায় কাক-কোকিল নেই। আচ্ছা, তুমি আমাকে স্বপ্নে দেখবে তো?
আমি বললুম, নিশ্চয়ই।
মাথা, জুল্ফ, কানের দুল দোলাতে দোলাতে বললে, না, তা করতে পারবে না। আমার কড়া মানা। আমি খাটে শুয়ে ড্যাব ড্যাব করে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকবো আর তুমি প্রেমসে তোমার স্বপনচারিণীর সঙ্গে লীলা-খেলা করবে—সেটি হচ্ছে না। ও আমার সতীন-দজ্জাল বেটী ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
আমি বললুম, ‘তুমিও আমাকে স্বপ্নে দেখলে পার।’
আশ্চর্য হয়ে বললে, বল কী তুমি? তুমি পুরুষ মানুষ। চারটে প্রিয়েকে বিয়ে করতে পার, স্বপ্নে জাগরণে যে রকম খুশী ভাগাভাগি করতে পার। কিন্তু আমি মেয়েছেলে। আমার কেবল তুমি। আমি বললুম :
‘স্বপন হইতে শতশত গুণে
প্রিয়তর বলে গুণি?’
অর্থ আর সুর দুইই তার মন পেল।
বললে, ‘কান্দাহারে তোমাকে প্রতি রাত্রে স্বপ্নে আবাহন জানাতুম। তখন তোমাকে বিয়ে করি নি, তাই। আচ্ছা, এবারে তুমি চুপ কর, আর চোখ বন্ধ কর।’
উঠে গিয়ে আলো নেবাল। ড্রইংরুমে থেকে এ ঘরে সামান্য আলো আসে।
আমার ছোট্ট চারপাঈটির কাঠের বাজুতে হাল্কা ভাবে বসে সেই আধো-আলো অন্ধকারে অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল—আমি বন্ধ চোখে সেটা চোখের তারাতে তারাতে দেখতে পেলাম।
এবারে তার নিশ্বাস আমার ঠোটে এসে লাগছে।
ভীরু পাখির মত একবার তার ঠোঁট আমার ঠোঁট স্পর্শ করল—দুবার—শেষবারে একটু অতি ক্ষীণ চাপ।
এ অভিজ্ঞতা আমার জীবনে এই প্রথম নয়।
কৈশোরে যখন ওষ্ঠাধরের গোপন রহস্য আধা আধা কল্পনায় বুঝতে শিখেছি তখন আমি আকাশের তারার সঙ্গে মিতালী পাতাবার জন্য রাত্রিযাপন করতুম খোলা বারান্দায়। শরতের ভোরবেলা দেখতুম পাশের শিউলি গাছের বিরহবেদনা-ফোঁটা ফোঁটা চোখের জলের শিউলি আমার চতুর্দিকে ছড়ানো।
এক ভোরে অনুভব করলুম ঠোটের উপর তারই একটি।
এ সেই হিমিকা-মাখা, শব্নম-ভেজা শিউলি!
২.৫ শবনমের কথা অক্ষরে অক্ষরে ফললো
শব্নমের কথা অক্ষরে অক্ষরে ফললো। পরদিন সকাল থেকেই কাবুল শহরের আশপাশের চোর ডাকু এসে রাজধানী ভর্তি করে দিল। দাগী খুনীরাও নাকি গা-ঢাকা থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছে; কারণ পুলিশ হাওয়া, শান্ত্রী গায়েব।