একবার নিজে দেখালে, সে আমাকে কতখানি ভালবাসে।
ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দুবাহু প্রসারিত করে পিছনের দিকে ঠেলতে ঠেলতে ব্যালে-নর্তকীর মত দু হাতে দু পিঠ প্রায় দুইয়ে ফেলে বললে, ‘অ্যাত্তো খানি। প্লাস-প্লাস-’ বলতে বলতে আমার কাছে এসে, আমার চোখের সামনে তার কড়ে আঙুল তুলে ধরে, বুড়ো আঙুলের নখ দিয়ে কড়ে আঙুলের ক্ষুদ্রতম কণায় ঠেকিয়ে বললে, ‘প্লাস অ্যাটুকুন।’ তারপর শুধালে, এর মানে বল তো?
আমি বললাম, বলার একটা সুন্দর ধরন আর কী।
না। সবচেয়ে বেশী থেকে সবচেয়ে কম—দুয়ে মিলিয়ে, সেই হল ইনফিনিটি।
‘ওই য্ যা ভুলে গিয়েছিলুম-’ বলে ছুটে জানলার ধারে গিয়ে বললে, ‘ওই দেখ আদম-সুরৎ-পাগমানের আদম-সুরৎ কালপুরুষ। আমাদের বিয়ের ভোজে এসে বাইরে দাড়িয়ে আছে বেচারী।’ আকাশের দিকে তাকিয়ে বললে, তুমি আমাদের প্রেমের সাক্ষী।
আমি তাকে সপ্তর্ষির অরুন্ধতী বশিষ্ঠের গল্প বললুম। বৈদিক যুগে যে বর-কনেকে অরুন্ধতী দেখিয়ে ওঁরই মত তাকে পাশে পাশে থাকতে বলত সেটাও বললুম।
শব্নম উৎসাহের সঙ্গে বললে, কোথায়? কোথায় দেখিয়ে দাও তো আমায়।
আকাশে তখনও সপ্তর্ষির উদয় হয় নি।
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল।
২.৪ মাত্র একটি অঙ্গে আমাদের বিয়ে
মাত্র একটি অঙ্গে আমাদের বিয়ে সর্বাঙ্গসুন্দর হয়েছিল।
শব্নম এই প্রথম খবর দিয়ে আসছিল বলে আবদুর রহমান কাবুল বাজার ঝেঁটিয়ে খান-পিনার সাজ-সরঞ্জাম কিনে রেখেছিল। রাত বারোটায় দস্তরখান পাতা হল, পদের পর পদ আসতে লাগল। শব্নম ওদের নিমন্ত্রণ করল, আমাদের সঙ্গে বসে খেতে। সিন্ধুর ওপারে সেবকগণ প্রভূ পরিবারের সঙ্গে বসে খেতে সম্পূর্ণ অনভ্যস্ত নয়। ওরা কিন্তু রাজী হল না। শোনাবার মতলবে ওদের ফিসফিস থেকে বোঝা গেল, ওরা বাজী ধরেছে, কে বেশী পোলাও খেতে পারে-প্রচুর সময় লাগার কথা।
শব্নম মাথা গুঁজে খেল। রুটি দিয়ে জড়িয়ে ধরে মাংস, তরকারি এমন কি ঝোল পর্যন্ত তুলে খেল, অথচ রুটি ছাড়া অন্য কোনও জিনিস হাতের সংস্পর্শে এল না, শুধু আমি দুজন লোককে করতে দেখেছি, শব্নম আর ভূপালের এক প্রধান মন্ত্রী। এদের খাওয়ার পর হাত ধেবার প্রয়োজন হয় না। রুটির যেটুকু ময়দার গুড়ো আঙুলের ডগায় লেগেছে সেটুকু ন্যাপকিনে মুছে নিলেই হল। শব্নম আমাকে কিছু না বলে হাত ধুয়ে এসে আমার পাশে বসে বললে, তুমি কিছু মনে করো না; এ ব্যাপারে আমার লজ্জাবোধ একটু বেশী।
বাইরে ভয়ঙ্কর শীত। চিমনিতে আবার কাঠ দেওয়া হল।
আগুনের সামনে আমরা দুজানা কার্পেটের উপর বসে আছি।
শব্নম প্যারিসের গল্প বলছে। মাঝে মাঝে আমার হাতখানা কোলে তুলে নিয়ে আদর করছে। একবার হৃদয় সম্বন্ধে কী একটা বলতে গিয়ে বললে, ‘এই তো তোমার হার্ট-’ বলে তার ডান হাত আমার বুকের উপর রাখতে গিয়ে তার হাত সেই ভিজিটিংকার্ড কেসটায় ঠেকল। সঙ্গে সঙ্গে চুপ করে গেল।
আমি শুধালুম, কী হল?
“তোমার ঘরে কাঁচি আছে?”
‘বোস। শোবার ঘরে নিয়ে গিয়েছিলুম। এনে দিচ্ছি।’
বললে, ‘বা রে! এখন আমি সর্বত্র যেতে পারি।’ বলেই পাখি যে রকম বসা অবস্থাতেই ওড়া আরম্ভ করতে পারে সেই রকম ফুড় করে উড়ে গিয়ে কচিখানি নিয়ে এল।
আমাকে মুখোমুখি বসিয়ে আমার হাতে কাঁচি দিয়ে বললে, আমার জুল্ফ কাটো।
বাঙলা জুলপি কথাটা জুলফ্ থেকে এসেছে। ইরান তুরানের কুমারীদের অনেকেই দু গুচ্ছ অলক রগ থেকে কানের ডগা অবধি ঝুলিয়ে রাখে। শব্নমের চুল ঢেউ-খেলানো হলে তার জুল্ফ দুটির সৌন্দর্য ছিল অসাধারণ।
আমি ঠিক জানি নে, একদা বোধ হয় ইরান তুরানের বর বাসর ঘরে নববধূর জুল্ফ দুটি পুরোপুরিই কেটে দিত। এর পর যে নূতন চুল গজাত নববধূ সে চুল কানের পিছনে অন্য চুলের সঙ্গে মিলিয়ে দিত। জুল্ফে হক্ক কুমারীদের-ইরানে বলা হয় ‘দুখ্তর’ সংস্কৃতে ‘দুহিতৃ’ স্পষ্ট বোঝা যায়, একই শব্দ। আজকাল এই জুল্ফ কাটার রেওয়াজ যে-সব জায়গায় আছে সেখানেও বোধ হয় জুলফের শুধু ডগাগুলোই কেটে দেওয়া হয়।
আমি বললাম, আমার হাত কেটে ফেললেও তোমার জুল্ফ কাটতে পারব না।
অনুনয় করলে, তা হলে ডগাগুলো কেটে দাও।
আমি বললাম, আমায় মাফ কর।
‘আমি চিরকালই কুমারী থাকব?’
‘তুমি চিরকালই আমার সামনে পাগমানের সেই ডানস্-হল থেকে নামছ, তুমি চিরকালই আমার প্রথম সন্ধ্যার হিমিকা। কিন্তু বলতো, তুমি এই জুল্ফ কাটা নিয়ে এত চাপ দিচ্ছ কেন?’
‘তবে কাছে এস।’
আমি আমার দুই তর্জনী দিয়ে তার দুটি জুল্ফ আঙুল দিয়ে পাকিয়ে পাকিয়ে তার মুখ তুলে ধরে বললুম, বল।
“দেখ, চারদিকে এই অশান্তি এই অনিশ্চয়তা, এর মাঝখানে তোমাকে নিঃশেষে পাবার জন্য আমার হৃদয় আমাকে ভরসা দিচ্ছে না।”
আমি বললুম, আমি তো চাই।
আমার দু হাতে ধরা জুল্ফি-বন্ধনের মাঝখানে যতটা পারে মাথা দুলিয়ে বললে, “না, না, না। তুমি আমাকে এত বেশী ভালবাস যে তোমার চাওয়া-না-চাওয়া সব লোপ পেয়েছে। আমার ভালবাসা তার কাছে দাড়াঁতেই পারে না।”
‘এবারে ভাল করে শোন। বিয়ের আগে তোমার সঙ্গে আমি এমন কোনও আচরণ করি নি যার জন্যে আল্লার সামনে আমাকে লজ্জা পেতে হবে। কিন্তু তোমার অসাক্ষাতে, এখানে কান্দাহারে, দিনের পর দিন, রাত্রির পর রাত্রি, দুপুর রাত্রে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গিয়ে সন্ধ্যা প্রদীপ না জ্বেলে গৃহকোণে কতবার আমি তোমাকে আমার সর্বস্ব সমর্পণ করেছি, তুমি জান না। চতুর্দিকে বিশ্বসংসার তখন প্রতিবার লোপ পেয়ে গিয়েছে একেবারে নিঃশেষে। আমি যেন বেলাভূমিতে দাড়িয়ে, আর তুমি মহাসিন্ধু, দূর থেকে তরঙ্গে তরঙ্গে ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসছ। আমি দম নিয়ে নাক-মুখ বন্ধ করার আগেই তুমি আমাকে তরঙ্গের আলিঙ্গনে আমার সর্বস্বত্তা লোপ করে দিলে। আর কখনও তুমি এসেছ ঝড়ের মত। আমার ওড়না তুলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, আমার জুল্ফগুচ্ছের ভিতর ঢুকে গিয়ে তার প্রত্যেকটি চুল আলাদা আলাদা করে এদিক ওদিক উড়িয়ে দিয়ে, আমার চোখের প্রতিটি কাজলের গুঁড়ো কেড়ে নিয়ে, আর সর্বশেষে আমার প্রতিটি লোমকূপে শিহরণ জাগিয়ে আমাকে যেন তোমার সর্বাঙ্গে জড়িয়ে কোথায় কোথায় উধাও হয়ে গেলে-কালপুরুষের পাশ দিয়ে কৃত্তিকা, সাত-ভাই চম্পার ঝাঁকের মাঝখান দিয়ে।