এ যেন শব্নমের গলা নয়। দূর থেকে ভেসে আসছে, অতি মৃদুকণ্ঠে তার সম্মতি।
তিনবার ওই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে হল। তিনবার সে সম্মতি জানালে।
আমি সাক্ষীদের দিকে তাকিয়ে বললুম, ‘আপনারা এই বিবাহের শাস্ত্র-সম্মত দুই সাক্ষী। আপনারা আমার প্রস্তাব আর মুসম্মৎ শব্নম বানুর সম্মতি তিনবার শুনেছেন?’
দুজনাই বললে, শুনেছি।
শব্নমের কথা ঠিক হলে আনুষ্ঠানিক বিবাহ এইখানেই শেষ। তোপল্ খান বহু বিয়ে দেখেছে বলে দুহাত তুলে একটা প্রার্থনা করল। আমিও হাত তুললুম। শব্নম মাথা নিচু করে, একেবারে মাটির কাছে নামিয়ে, দুহাত দিয়ে প্রায় মুখ ঢেকে।
প্রার্থনাতে মাত্র একটি কথা ছিল। ‘হে খুদা, আদম এবং হাওয়ার মধ্যে, ইউসুফ এবং জোলেখার মধ্যে, হজরৎ এবং খাদিজার মধ্যে যে প্রেম ছিল, এ দুজনার ভিতর সেই রকম প্রেম হোক।’
আবদুর রহমান উদ্বাহু হয়ে প্রার্থনার সময় জোর গলায় ঘন ঘন বললে, ‘আমিন, আমিন হে আল্লা তাই হোক, তাই হোক।’
আমিন! আমিন!! আমিন!!!
ওরা দুজন চলে যাওয়ার পর আমি যেখানে ছিলাম সেখানেই বসে রইলুম। কিছুই তো জানি নে তারপর কি করতে হয়। শব্নমও কিছু বলে নি।
উঠে গিয়ে সামনে বসে বললুম, শব্নম।
তাকিয়ে দেখি ওড়না ভেজা।
কিছু না ভেবেই ওড়না সরালুম। সুস্থ বুদ্ধিতে পারতুম না। দেখি, শব্নমের চোখ দিয়ে জল ঝরছে।
শুধালুম, “এ কী?”
শব্নম চোখ মেলে বললে, বলো!
তখন দেখি, আমার বলবার কিছুই নেই।
তাকে তুলে ধরে সোফার দিকে নিয়ে যেতে গিয়ে দেখি সেটাকে সরানো হয়েছে। আমি সেদিকে যাচ্ছিলাম। বললে, ‘না। ওদের ডাক। তোমার ঘর আমি সেই রকমই চাই।’ ঘর ঠিক করা হল।
বললে, “তুমি শোও।”
আমার পাশে আধ-হেলান দিয়ে বসে আমার চুলের ভিতর আঙুল চালাতে চালাতে বললে, “ঠিক এরকম হবে আমি ভাবি নি। আমি ভেবেছিলুম, হয়ত খানা-পিনা গান-বাজনা বোমা-বারুদ ফাটিয়ে বিয়ের ব্যবস্থা আমি করতে পারব। আর তা সম্ভব না হলে আমি অন্যটার জন্যও তৈরী ছিলুম।”
আমি বললুম, এই তো ভাল।
“সে কি আমি জানি নে? খানা-পিনা বন্ধু-সমাগম হল না, তার জন্যে আমাদের কি দুঃখ? তবে একটা পদ এত বেশী হচ্ছে যে আর সব পুষিয়ে দিচ্ছে। শুনছ শাদীর ‘শাদীয়ানা?’ বোমা-বারুদ? কী রকম কন্দুক মেশিনগানের শব্দ হচ্ছে? আমানুল্লার শালীর বিয়েতেও এর এক আনা পরিমাণও হয় নি! ডাকাত আমাদের বিয়ের শাদীয়ানার ভার নিয়েছে-না? এও তো ডাকাতির বিয়ে!”
আমি কিচ্ছুটি বলি নি। আমার হিয়া কানায় কানায় ভরা। আমার জাহাজ বন্দরে ভিড়েছে। পাল দীর্ঘ, অতি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে হাওয়াকে মুক্তি দিয়েছে। হাল-বৈঠা নিস্তব্ধ। উটের ঘন্টা আজ বাজছে না।
বললে, আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাই।
এবারে আমাকে মুখ খুলতে হল।
ডান হাত দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরে বললে, আমার শওহর—স্বামী কথা বলে কম। শোন-
‘তোমাকে বড় কষ্ট দিয়েছি। তুমি আমাকে কতখানি চাও, সে আমি জানতুম। আরও জানতুম, সর্বশেষ চাওয়া, সমাজের সামনে পাওয়া, তুমি সাহস করে নিজের মনের কাছেই চাইতে পার নি। আমার কাছে বল—সে তো বহু দূরে। আমার কিন্তু তখন বড্ড কষ্ট হয়েছে। যখন নিতান্ত সইতে পারি নি তখন শুধু বলেছি, আমার কাছে ওষুধ আছে। তুমি নিশ্চয়ই আস্মান জমীন হাতড়েছ, কী ওষুধ? তুমি বিদেশী, তুমি কী করে জানবে যে, যত অসুবিধেই হোক আমি আমার দেশের, সমাজের সম্মতি নিয়েই বিয়ে করতে চাই। আমার জন্য অতখানি নয়, যতখানি তোমার জন্যে। তুমি কেন ডাকাতের বেশে আমাকে ছিনিয়ে নেবে? মায়-মুরুব্বি, ইয়ার দোস্ত এবং আরও পাঁচ জনের প্রসন্ন কল্যাণ আশীর্বাদের মাঝখানে, আমরা একে অন্যকে বরণ করব। গুল বুলবুল এক বাগিচাতেই থাকবে। চতুর্দিকে আরও ফুল আরও বুলবুল। আমি কোন্ দুঃখে আমার শাখা ছেড়ে তোমাকে ঠোটে করে নিয়ে মরুভূমির কিনারায় বসব?’
‘সমাজ আপত্তি করলে?’
‘থোড়াই পরোয়া করতুম। ধর্মমতে তুমি আমি, সমাজ কেন, বাপ-মায়ের আপত্তি সত্ত্বেও বিয়ে করতে পারি। কিন্তু সমাজ কি শের না বাবুর, বাঘ না সিংহ, যে তাকে হামেহাল পিস্তল দেখাতে হবে? সমাজ তেজী ঘোড়া। দান-পানি দেবে, তার পিঠে চড়বে। বেয়াড়ামি করলে পায়ের কাঁটা দিয়ে অল্প গুঁতো দেবে, আরও বেশী হলে চবুক, আর এক দম বিগড়ে গেলে পিস্তল। তারপর নুতন ঘোড়া কিনবে-নুতন সমাজ গড়বে।
‘আর এখন।’
‘এখন তো সবকিছু ফৈসালা হয়ে গেল। প্রথম বলি, কাবুলের সমাজ আমাদের সমাজ নয়। আমাদের গুটিকয়েক পরিবার নিয়ে আমাদের সম্পূর্ণ সমাজ। সে সমাজ এখন আমাদের আশীর্বাদ করবে। জান, এদেশে এরকম বিশৃঙ্খলা প্রায়ই হয়। গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে লড়াই, শহরে শহরে লড়াই, রাজায় রাজায় লড়াই। রাজায় ডাকুতে অবশ্য এই প্রথম। তখন ভিন মহল্লায় গিয়ে কখনও কখনও পনেরো দিন, এক মাস আটকা পড়ে যেতে হয়। সমাজ শুনে বলবে, ‘এই তো ভাল। তারা শাস্ত্রানুযায়ী কাজ করেছে।’ পরে যখন সমাজপতিরা কানাঘুষো শুনবেন, আগের থেকে মহব্বৎ ছিল, তখন তারা আরও খুশী হয়ে দাড়ি দুলোতে দুলোতে বলবেন, ‘বেহ্তর শুদ, খয়ুলী বেহতর শুদ—আরও ভাল। লোকলজ্জার ভয়ে বিয়ে করার চেয়ে দিলের টানে বিয়ে করা অনেক ভাল-বহুৎ বেহতর।’
‘তুমি কিন্তু ভেবো না, তোমার বাড়িতে পনেরো দিন থাকতে হবে বলে সেই অছিলা নিয়ে তোমাকে বিয়ে করেছি। তোমাকে বিয়ে করার জন্য আমি আমার হৃদয়ের হয়ে মনের কাছে প্রস্তাব পেশ করি হোটেলের বারান্দায়। মন বিচক্ষণ জন। সে সায় দিলে, অনেক ভেবে-চিন্তে নদী তীরে।’