আস্তে আস্তে তার হাত দুটি ছাড়িয়ে নিয়ে আমার হাতের উপর বুলোতে বুলোতে বললে, আমি পাগল, না, কি? বন্ধু, তুমি কিছু মনে কর না। এই এক বছর ধরে-
বাধা দিয়ে অতি কষ্টে বলল, আমার উপর মেহেরবান হও-প্রসন্ন হও। আমি কি জানি নে আমি কত অভাজন। তুমি এ শহরে—
এবারে হেসে উঠে বাধা দিয়ে বললে,—’—সবচেয়ে সুন্দরী (আমি কিন্তু তার কুল গোষ্ঠির কথা বলতে যাচ্ছিলুম)। না? আমি কুৎসিৎ হলে তুমি আমায় ভালোবাসতে না-সে তো কিছু বিচিত্র নয়। কিন্তু আমি মাঝারি হলে কি করতে, বল তো?’
আমি ঝড় কাটাতে ব্যস্ত। হালের সঙ্গে পাল। বললুম, এ রকম প্রশ্ন আমি কোনও বইয়ে পড়ি নি। সাধারণত মেয়ে শুধায়, সে সুন্দরী না হলে ভালোবাসা পেত কি না?
উত্তর দাও।
‘আমি নিজে তো মাঝারি। তুমি তো বেসেছ। এবং সবচেয়ে বড় কথা, তুমি তুর্কী রমণী। তুমি-’
ব্যস্, ব্যস্, থাক থাক। এবার এদিকে এস। আমার ব্যাগটা খোল তো। হ্যাঁ, ওই রুমালে বাঁধা জিনিস।
সামনের টেবিলে সেটি রেখে রুপোতে সিল্কেতে কাজ করা কিংখাপের রুমালের গিঁট আস্তে আস্তে অতি সন্তর্পণে খুলতে লাগল যেন তীর্থের প্রসাদী। আমি এক দৃষ্টে দেখছিলুম, তার আঙুলের খেলা। প্রত্যেকটি আঙুল যেন এক একটি ব্যালে নর্তকী। হাতের কব্জী দুটি একদম নড়ছে না আঙুলগুলো এখানে যায়, সেখানে যায়, একটা অসম্ভব এ্যাঙ্গেল থেকে চট করে আরেক অসম্ভব এ্যাঙ্গেলে চলে যায়। পিয়ানো বাজানো এর কাছে কিছুই নয়; সে তো শুধু ডাইনে বাঁয়ের নড়ন চড়ন।
দুখনা রুমাল খোলার পর বেরল গাঢ় নীল রঙের চামড়ায় বাঁধানো একখান ছোট্ট বই। চামড়ার উপর সূক্ষ্ম সোনালী কাজ। চার কোণ জুড়ে ট্যারচা করে অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফুললতা পাতার নকশার কাজ তারই মাঝে মাঝে বসে ক্ষুদে ক্ষুদে পাখি। বইয়ের মাঝখানে একটি জোরালো গোল মেডালিয়ন, নামাঙ্কন-স্বাক্ষরলাঞ্চন সহ।
বললে, আরও কাছে এস।
আঙুলের ডগা দিয়ে আস্তে আস্তে এক একটি করে পাতার প্রান্ত বুলিয়ে সেটিকে উল্টোয় আর সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে আসে যেন একটি করে নূতন বাগান। পাতার মাঝখানে কুচকুচে কালো কালিতে হাতের লেখা ফার্সী কবিতা আর তার চতুর্দিকের বর্ডারে আবার সেই লতা আর পাখির মতিফ। অতি ছোট্ট ছোট্ট গোলাপী রজেটের পাশে ডালের উপর বসে ক্ষুদে ক্ষুদে বুলবুল। কখনও আকাশের দিকে তাকিয়ে লতার উপর দুলছে, কখনও বা ঘাড় নিচু করে গোলাপ কুঁডির সঙ্গে কানে কানে কথা কইছে। সখী, জাগো, জাগো। পাঁচ ছটা রঙের এক সপ্তকেই সঙ্গীত বাঁধা হয়েছে, কিন্তু আসল পকড় সোনালী, নীল আর গোলাপীতে।
বললে, ‘লেখাটা করে দিয়েছেন আগা-ই-আগা ওস্তাদ সিরবুলন্দ্ কিজ্লবাশ। উনিই আমাদের শেষ জরীন-কলম, সোনার কলমের মালিক। তাঁর ছেলে পর্যন্ত হিন্দুস্থান চলে গিয়েছে ছাপাখানার কাজ শিখতে!’ একটি ছোট্ট দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে।
প্রতি দু পাতার মাঝখানে এক একখানি করে অতি পাতলা সাদা কাগজ। আতর মাখানো।
বুঝিয়ে বললে, পোকায় কাটবে না আর আতরের তেলের স্নেহ কাগজকে শুকনো হতে দেবে না। আমার মনে পরল সত্যেন দত্তের ফার্সী কবিতার অনুবাদ,
‘তবু বসন্ত যৌবন সাথে দুদিনেই লোপ পায়
কুসুমগন্ধী যৌবন পুঁথি পলে উলটিয়ে যায়।’
আবার এ কী অপয়া বচন? না, না। সৃষ্টির প্রথম দিনের প্রথম বুলবুলের সঙ্গে প্রথম গোলাপের মৃদু মর্মর গানে মর্মের বাণীর কানাকানি এখনও আছে, চিরকাল থাকবে।
শব্নম কিন্তু-কিন্তু করে কি যেন বলতে চাইছে, বলছে না। আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি সেমুখ একেবারে সিদুরের মত টকটকে।
আমি তাকাতেই সেই মুখে যেন ঘামের ফোঁটা দেখা দিল। শব্নমের মুখে শব্নম! ঘাড় ফিরিয়ে অপরাধীর মৃদুকণ্ঠে বললে, আর বর্ডারগুলো আমার আঁকা!
বলেই ছুটে গেল সিঁড়ির দিকে।
আমি হরিণশিশুকে নরগিস বনের ভিতর দিয়ে নাচতে দেখলুম। আমার বুখারা-কার্পেট ছিল নরগিস মতিফ।
সিঁড়ির মুখে গিয়ে হাকলে, ‘আগা আবদুর রহমান। চা খাবে?’
আবদুর রহমান হুঙ্কার ছাড়লে, ‘চশম।’-যেন হুকুমটা কান্দাহার থেকে এসেছে, জবাব সেখানে পৌঁছনো চাই।
কী সৌজন্য! ‘চা খাবে?’ ‘চা আন’, নয়। অর্থাৎ ‘তুমি যদি খাও, তবে আমিও যেন এক পেয়ালা পাই।’ ভৃত্যকে সহচরের মত মধুর সম্ভাষণ। আর আমার আবদুর রহমানও কিছু কম নয়। ‘চশম’— অর্থাৎ আপনার ইচ্ছা অনিচ্ছা আমার ‘চশম’, চোখের মত কিস্মৎবার মূল্যবান।
আমার মূল বিস্ময় কিন্তু এতে তো চাপা পড়ে না।
তুমি এঁকেছ?
নীরব বীণা।
তুমি এঁকেছ?
যেন অতি দূরে সে বীণার প্রথম পিড়িং শোনা গেল। ‘বড় কাচাঁ।’
আমি সপ্তমে বললুম, ‘কাঁচা? আশ্চর্য! কাঁচা? তাজ্জব! ক’টা ওস্তাদ এ রকম পারে?’
এবারে কাছে এসে হেসে বললে, তুমি কিছু জান না। তাই তোমাকে কবিতা শুনিয়ে সুখ, তোমাকে ছবি দেখিয়ে আনন্দ।
আমি রাগ করে বললুম, ‘তুমি কি আমাকে অজ গাঁইয়া পেয়েছ? দিল্লীর মহাফিজখানাতে আমার দোস্ত রায় আমাকে কলমী কিতাব দেখায় নি?’
আমাকে খুশী করার জন্য বললে, ‘তাই সই, তাই সই, ওগো তাই সই। কিন্তু আমার ওস্তাদ আগা জমশীদ বুখারী বলেন, “রোজ আট ঘন্টা করে ত্রিশ বছর আঁকার রেওয়াজ করলে তবে ছবি আঁকার কল রপ্ত হয়। এবং তারপর চলে যাবে চোখের জ্যোতি।”
আমি অবাক হয়ে বললুম, বল কি?
‘হ্যাঁ। এবং বলেন, “কিন্তু কোনও দুঃখ নেই। তুমি নিজেই জান না তোমার মূল্য কি?”